Table of Contents
আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা (র.) জন্ম ১২৭২ হি. (১৮৫৬ খ্রি.) ওফাত ১৩৪০হি. (১৯২১ খ্রি.) বিশ্বব্যাপী পরিচিত এক বিস্ময়কর অসাধারণ প্রতিভা। প্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্যের সর্বত্র আজ তাঁর চিন্তাধারা শিক্ষা ও জীবন দশর্ন সম্পর্কে আলোচনা ও গবেষণা চলছে। তাঁর জীবন কর্ম মূল্যায়ন ও অবদান সর্ম্পকে বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৬ জন গবেষক ৩৬টি শিরোনামে পি-এইচ.ডি. ডিগ্রী অর্জন করেছেন, ২৭ জন গবেষক এম.ফিল ডিগ্রী সম্পন্ন করেছেন। আরেক গবেষক ড. মুহাম্মদ মুকাররম আহমদ “ইমাম আহমদ রেযা কী আদবী খিদমত” শিরোনামে ভারতের দিল্লী জওহারলাল ইউনিভার্সিটি হতে ১৯৯৮ খ্রি. ডি. লীট ডিগ্রী অর্জন করেন। ভারতের উত্তর প্রদেশের বেরেলী শহরে যদিও তাঁর আবির্ভাব; কিন্তু দেশ কাল ও ভৌগলিক সীমানার ঊর্দ্ধে তাঁর অবস্থান। এ জাতীয় মনীষীরা গোটা বিশ্বের সম্পদ। ১৩৪০ হিজরিতে বিশাল কর্মময় জীবনে মিল্লাত মাযহাবের জন্য জ্ঞান সমুদ্র রেখে তিনি ইহকাল ত্যাগ করেন। তিনি ইতিহাসের কিংবদন্তি। নবী মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুযোগ্য ইলমী উত্তরাধিকার হিসেবে তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণে জ্ঞানী ওলামা-মাশায়েখসহ মুসলিম বিশ্বের এক বিশাল অংশের অন্তরাত্মা আজ তেজোদীপ্ত ও আলোকিত।
তরজমা কুরআন কানযুল ঈমান তাঁর শ্রেষ্ঠ কীর্তি
আ’লা হযরত অনূদিত তরজমা-ই কুরআন কানযুল ঈমান-এর সূচনা প্রসঙ্গে আল্লামা আবদুল মুবীন নোমানী বর্ণনা করেন, “কানযুল ঈমান লিখার সূচনা হয় জমাদিউল আখের ১৩৩০ হিজরিতে, অনুবাদ কর্ম সমাপ্ত হয় ২৮ জমাদিউল আখের ১৩৩১ হিজরিতে (মুতাবিক ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে) মাঝখানে কিছু দিন বিরতি ছিলো। বৎসরের কয়েক মাসের মধ্যেই অনুবাদ কর্ম সম্পন্ন হয়। এক্ষেত্রে পুরো এক বৎসর সময়ও ব্যয় হয়নি।
কানযুল ঈমান-এর উপর পি-এইচ.ডি.
আ’লা হযরতের জীবন ও কর্মের গবেষণা বিষয়ক, আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান এদারায়ে তাহকীকাতে ইমাম আহমদ রেযার সেক্রেটারী জেনারেল “মারেফে রেযা” মাসিক পত্রিকার সম্পাদক করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের পেট্রোলিয়াম এন্ড টেকনোলোজি বিভাগের প্রফেসর ড. মজিদ উল্লাহ কাদেরী, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব খ্যাতিমান আ’লা হযরত গবেষক প্রফেসর মুহাম্মদ মাসউদ আহমদ (র.)’র তত্ত্বাবধানে ১৯৯৩ খ্রি. “কানযুল ঈমান আওর দিগর মারুফ উর্দু তারজুমে কুরআন কা তাকাবুলি জায়েযাহ” শিরোনামে পি-এইচ,ডি. ডিগ্রী অর্জন করেন। এ পর্যন্ত বাংলা ভাষাসহ পৃথিবীর ৭টি ভাষায় যথাক্রমে ইংরেজী, হিন্দি, গুজরাটি, সিন্ধু, ডাচ, তুর্কী ও বাংলা ভাষায় মোট ১৪ জন খ্যাতিমান আলেম ও গবেষক কানযুল ঈমান-এর অনুবাদ প্রকাশ করেছেন।
বিশ্ববরেণ্য আলেমেদ্বীন বোখারী শরীফের ব্যাখ্যাকারক আ’লা হযরত গবেষক ফকীহুল হিন্দ হযরত আল্লামা মুফতি শরীফুল হক আমজাদী (র.) এর বর্ণনা মতে, ১০ শাওয়াল ১২৭২ হিজরীতে তাঁর জন্ম, ২৫ সফর ১৩৪০ হিজরিতে তাঁর ওফাত। হিজরি সাল অনুপাতে তাঁর জীবনকাল ৬৭ বৎসর ৫ মাস ১৫দিন।
১৪ শাওয়াল ১২৮৬ হিজরিতে তিনি ফাতওয়া প্রণয়ন শুরু করেন। এ হিসেবে ১৩৪০ হিজরি পর্যন্ত সুদীর্ঘ ৫৩ বৎসর ৬ মাস ১১ দিন সময়কাল পর্যন্ত ফাতওয়া প্রণয়নে দক্ষতার স্বাক্ষর রাখেন। জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখা-প্রশাখায় ৭৪ টির অধিক বিষয়ে সহ¯্রাধিক গ্রন্থ রচনার পাশাপাশি ফিক্হে হানফীর ইনসাইক্লোপিড়িয়া তথা বিশ্বকোষ নামে খ্যাত (العطايا النبوية فى الفتوي الرضوية) “আল আতায়া আন্ নবভীয়্যাহ ফিল ফাতাওয়া আর-রিজভীয়্যাহ” নামে বিশাল ফাতওয়া গ্রন্থ গ্রণয়ন করেন। লক্ষাধিক ফাতওয়ার বিশাল সম্ভার বর্তমানে ত্রিশ খন্ডে প্রকাশিত। পৃষ্ঠা সংখ্যা ২১,৬৫৬। সর্বমোট প্রশ্নত্তোর সংখ্যা ৬৮৪৭ যা ২০৬টি ফাতওয়া সংক্রান্ত পুস্তিকার বিশাল সম্ভার।ফিকহে হানফীর জগতে তাঁর অনন্য অবদান “ফাতওয়ায়ে রিজভীয়্যাহ”।
এছাড়াও আ’লা হযরত দৈনিক গড়ে ৫৬ পৃষ্ঠা লিখা নিয়মিত লিখেছেন। সেই অনুপাতে পৃষ্ঠা সংখ্যা দাঁড়ায় ১০,৬৫৮৪৩ (দশ লক্ষ পয়ষট্টি হাজার আটশত তেতাল্লিশ) পৃষ্ঠা।
আ’লা হযরতের ফিকহী মানসের উপর পি-এইচ.ডি. অর্জন
আল্লামা হাসান রেযা খান আজমী “ফকীহে ইসলাম ইমাম আহমদ রেযা খান” শিরোনামে ড. আতহার শের-এর তত্ত্বাবধানে ভারতের পাটনা ইউনিভার্সিটি হতে ১৯৭৯ খ্রি.পি-এইচ.ডি.ডিগ্রী অর্জন করেন।
নবী প্রশস্তির এক অমর কাব্য গ্রন্থ হাদায়েকে বখশিশ
হাদায়েকে বখশিশ নবী করীমের প্রশংসার প্রশস্তিতে লিখা আ’লা হযরত-এর অমর কাব্য সংকলন। তিনি রচনা করেন রসূলের প্রতি প্রেম ভালবাসার অপূর্ব নিদর্শন নাতিয়া কালাম।
“মোস্তফা জানে রহমত পেহ্ লাখো সালাম
শময়ে বযমে হেদায়ত পেহ্ লাখো সালাম।”
এমন শাশ্বত কাব্য পংক্তির কোন নজির নেই। শত সহ¯্রবার উচ্চারিত হয়েও এর আবেদন এতটুকু নিস্প্রভ হয়নি। রাসূলের সুমহান শান-মান, মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব অনুধাবন, আক্বিদাগত বিভ্রান্তি নিরসন ও বাতুলতার স্বরূপ উম্মোচনে তাঁর লিখনী এক অব্যর্থ প্রতিষেধক। তাঁর রচিত কবিতার ছত্রে ছত্রে নবী প্রেমের যে অনন্য সূর অনুরণিত হয়েছে তা তাঁর অকৃত্রিম আনুগত্য ও মুহব্বতের অক্ষয় শ্রুত ধ্বনি।
পৃথিবী কবি ও কাব্য কম দেখে নি; কিন্তু ইমাম আহমদ রেযার অন্তরাত্মা ছিলো খোদা প্রদত্ত অসাধারণ প্রতিভা, আশ্চর্য প্রভা ও প্রজ্ঞায় আলোকিত। ইমাম বেরলভীর কাব্য মানসের উপর পৃথিবীর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বহু গবেষক এম.ফিল. ও পি-এইচ.ডি. ডিগ্রী সম্পন্ন করেন। বার্মিং হাম ইউনিভাসির্টি (যুক্তরাষ্ট্র), পাঞ্জাব ইউনির্ভাসিটি (পাকিস্তান), মুসলিম ইউনিভাসির্টি (ভারত) এবং ময়শুর ইউনিভর্সিটি (ভারত)সহ বিশ্বের সর্বোচ্চ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা কর্ম হয়েছে এবং হচ্ছে। সম্প্রতি প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নামে খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষক মাওলানা নাসির উদ্দিন ড. প্রফেসর আবদুর রশীদ-এর তত্ত্বাবধানে বাংলা ভাষায় আ’লা হযরতের কাব্য সাহিত্যের উপর পি-এইচ.ডি.ডিগ্রী অর্জন করেন।
বিশ্ববরণ্যে বহু খ্যাতিমান আলেমেদ্বীন হাদায়েকে বখশিশ-এর ব্যাখ্যা গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁরা হলেন- আল্লামা মুফতি নসরুল্লাহ খান (করাচি) শায়খুল হাদীস আল্লামা ফয়েজ আহমদ ওয়েসী (ভাওয়ালপুর), আল্লামা মুফতি মুহাম্মদ খান (লাহোর), আল্লামা গোলাম ইয়াসীন আমজাদী প্রমুখ। ইসলামী বিশ্বের প্রাচীনতম বিদ্যাপীঠ ইসলামী ঐতিহ্যের স্মারক মিসর আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়-এর অধ্যাপক প্রফেসর ড. হাফেয মুহাম্মদ মাহফুয ইমাম আহমদ রেযা প্রণীত অমর কাব্যের ৩৫০ পৃষ্ঠা সম্বলিত এক বিরাট সংকলন প্রকাশ করেন যা “বাসাতিনুল গুফরান” নামে ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত হয়েছে।
মিসর আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ে আ’লা হযরত চর্চা
বিশ্বের অন্যান্য বিদ্যাপীঠের মতো আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকমন্ডলী ইমাম আহমদ রেযাকে শ্রদ্ধা ও সম্মানের দৃষ্টিতে দেখেছেন। তাঁরা শুধু তাঁকে জ্ঞান বিজ্ঞানের পুরোধা স্বীকার করেছেন তা নয়; বরং তাঁরা তাঁকে চতুর্দশ শতাব্দীর মহান মুজাদ্দিদ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
১৩৪০ হিজরি মুতাবিক ১৯২১ খ্রি. আ’লা হযরতের ইন্তেকালের পর হযরত শায়খ মুসা আশশামী আল আযহারী ইমাম আহমদ রেযা প্রণীত “আদ্দৌলাতুল মক্কীয়া” গ্রন্থে অভিমত ব্যক্ত করেন। “আমি আদ্দৌলাতুল মক্কীয়া” গ্রন্থ অধ্যয়ন করেছি, এটাকে নিয়ামক হিসেবে এবং সত্যান্বেষী আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের অনুসারীদের অন্তরের মহৌষধ হিসেবে পেয়েছি। গ্রন্থ প্রণেতা শায়খ আহমদ রেযা খান ইমামদের ইমাম এ উম্মতের মুজাদ্দিদ তথা সংস্কারক। অনুরূপ আল-আযহার-এর অধ্যাপক শায়খ ইবরাহীম আবদুল মুতী আশ-শাফেয়ী স্বীয় অভিমত ব্যক্ত করে বলেন যে, “আদ্দৌলাতুল মক্কীয়া” গ্রন্থটি অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য একটি উঁচুমানের স্তম্ভ। আল্লাহ তায়ালা এর জন্য ইমাম আহমদ রেযাকে উত্তম প্রতিদান দান করুন।
জামেয়া আল-আযহারের অধ্যাপক শায়খ আবদুর রহমান আল হানাফী আল মিসরী ১৩২৯ হি. (১৯৯১ খ্রি.) স্বীয় অভিমত ব্যক্ত করেন- মদীনা, মনোয়ারার কতেক বিজ্ঞজন আদ্দৌলাতুল মক্কীয়া সম্পর্কে আমাকে অবহিত করলো। আমার জীবনের শপথ, গ্রন্থ প্রণেতা এতে অতীব অর্থবহ নির্ভরযোগ্য প্রমাণাদি সন্নিবেশিত করেছেন। আ’লা হযরতের ইন্তেকালের অন্তত ৪২ বৎসর পর ১৯৬৩ খ্রি. আ’লা হযরত (র.)’র প্রপৌত্র তাঁর ইলমী উত্তরাধীকার তাজুশ শরীয়্যাহ আল্লামা আখতার রেযা আল আযহারী বিশ্বের প্রাচীনতম সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ জামেয়াতুল আযহারে আ’লা হযরতকে নতুনরূপে আবিষ্কার করেন। ইমাম বেরলভীর সুবিশাল দ্বীনি খিদমত ও বহুমাত্রিক অবদানের পরিচিত করান।
আল্লামা আখতার রেযা খান আল-আযহারে ইসলামী কানুন ও শরীয়া বিভাগে অধ্যয়নরত অবস্থায়, পরীক্ষক মহোদয় উক্ত বিভাগের শিক্ষার্থীদের নিকট ইলমুল কলাম বা আকিদা বিষয়ক কতিপয় জটিল কঠিন প্রশ্ন করলেন। আ্ল্লামা আযহারী ছাড়া কেউ উক্ত প্রশ্নমালার যথার্থ উত্তর দিতে পারেননি। তাঁর বিশুদ্ধ যথার্থ উত্তর শ্রবনে পরীক্ষক মহোদয় প্রশ্ন করলেন, আপনি তো হাদীস ও উসুলে হাদীস বিষয়ে পড়ালেখা করেছেন। ইলমুল কালাম তথা আকিদা বিষয়ক প্রশ্নাবলীর উত্তর দানে কীভাবে সক্ষম হলেন? তদুত্তরে বললেন, ‘আমি আমার বুযুর্গ পিতামহ ইমাম আহমদ রেযার প্রতিষ্ঠিত, জামেয়া রিজভীয়াহ মানযারুল ইসলাম বেরেলীতে কালাম শাস্ত্র অধ্যয়ন করেছি।
তাজুশ শরীয়্যাহ আল-আযহারের শায়খুল হাদীস আল্লামা শায়খ মুহাম্মদ সামাহী ও প্রফেসর আল্লামা আবদুল গাফফার (রহ.) সহ অভিজ্ঞ তাফসীর ও হাদীস বিশারদ ও প্রাজ্ঞজনদের নিকট জ্ঞানার্জন করেন। ১৯৬৬ খ্রি. তিনি সর্বোচ্চ সমাপনী ডিগ্রীতে ১ম শ্রেণিতে ১ম স্থান অধিকার করার গৌরব অর্জন করায় তৎকালীন মিসরের প্রেসিডেন্ট
কর্ণেল জামাল নাসের তাঁকে الدرع الأزهر তথা ফখরে আযহার এওয়ার্ড প্রদান করেন।
তাজুশ শরীয়্যাহ-এর সমসাময়িক ওলামা কেরামের মধ্যে সর্বপ্রথম প্রফেসর ড. শায়খ মহিউদ্দিন আলওয়ায়ী (আল আযহারের প্রফেসর) ইমাম আহমদ রেযার জীবন-কর্মের উপর আরবী ভাষায় এক দীর্ঘ প্রবন্ধ রচনা করেন। যা কায়রো-এর বহুল প্রচারিত “সওতুশ শারক” নামক পত্রিকায় ১৯৭০খ্রি. ফেব্রুয়ারী সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে।
জামেয়াতুল আযহারে আ’লা হযরত বিষয়ক লিখিত গ্রন্থাবলী
এক.বাসতিনুল গুফরান (بساتين الغفران)
হাদায়েক বখশিশ অবলম্বনে আরবি ভাষায় ৩৫০ পৃষ্ঠা সম্বলিত কাব্যানুবাদ গ্রন্থ। লেখক আল-আযহারের প্রফেসর ড. হাযেম মুহাম্মদ মাহফুয। গ্রন্থটি ১৪১৮হি. (১৯৯৭ খ্রি.)বাসাতিনুল গুফরান নামে প্রকাশিত হয়। ১৯৯৮ সনের ৬ জুন পাকিস্তানের করাচিতে অনুষ্ঠিত আ’লা হযরত কন্ফারেন্সে লেখককে আমন্ত্রণ জানানো হয়। তাঁকে রিসার্চ এওয়ার্ড সম্মানানা প্রদান করা হয়।
২.আদ দিরাসাতুর রেযভিয়া ফি মিসর আল-আরবিয়া (الدراسات الرضوية في مصر العربية) প্রফেসর ড. হাযেম আ’লা হযরতের জীবন-কর্মের উপর ‘আদদিরাসাতুর রেযভিয়াহ ফি মিসর আল-আরবিয়্যাহ’ শীর্ষক এক গবেষণাধর্মী প্রবন্ধও রচনা করেন। যা ১৯৯৮ খ্রি. মে মাসে মিশরের কায়রো দারুস সিক্বাফাহ লিন-নশর ওয়াত তাওযীহ প্রকাশনা সংস্থা দপ্তর কর্তৃক প্রকাশিত হয়।
৩.আল ইমামুল আকবর আল মুজাদ্দিদ আহমদ রিযা খান ওয়াল আলামুল আরবি
(الإمام الأكبر المجدد أحمد رضا خان والعالم العربي)
গ্রন্থটির লেখক প্রফেসর ড. হাযেম মাহফুয মিসরী কর্তৃক গ্রন্থটি ১৯৯৮ সনে প্রকাশিত পৃষ্ঠা সংখ্যা ২৪০।
৪. আহমদ রেযা খান আল বেরলভী আল হিন্দি শায়খুল মাশায়িখ তাসাউফ আল ইসলামি ওয়া আযমু শুয়ারাইল মাদীহ আন-নবভী
( أحمد رضا خان البريلوي الهندي شيخ مشانخ التصوف الإسلامي وأعظم شعراء المديح النبوي)
ড.হাযেম মাহফুজ কর্তৃক লিখিত ইমাম আহমদ রেযার সূফীতত্ত্ব ও প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শানে রচিত কাব্যের আরবী সংকলন। যা ১৯৯৯ খ্রি. কায়রো থেকে প্রকাশিত হয়।
৫.আল মানযুমাতুস সালামিয়া ফি মাদহি খায়রিল বারিয়্যা
(المنظومة السلامية في مدح خير البرية)
রাসূলুল্লাহর শানে আ’লা হযরত বিরচিত বিশ্বব্যাপী সমাদৃত সালামে রেযা খ্যাত ‘মুস্তফা জানে রহমাত পেহ্ লাখো সালাম’। ১৭১ টি পংক্তির আরবি কাব্যানুবাদ। আরবি ভাষার কাব্যানুবাদ করেন আল আযহারের খ্যাতিমান কবি প্রফেসর ড. হোসাইন মুজিব আল মিসরী।
৬.আল ইমাম আহমদ রেযা বাইনা নাক্কাদিল আদব ফি মিসর আল-আযহার- (الإمام أحمد رضا بين نقاد الأدب في مصر الأزهر) মিসরীয় সাহিত্য সমালোচকদের দৃষ্টিতে ইমাম আহমদ রেযা শীর্ষক গবেষণাধর্মী প্রবন্ধটি লিখেছেন প্রফেসর ড. হাযেম মাহফুয মিসরী।
৭.আহমদ রেযা খান মিসবাহুন হিন্দিউন বি-লিসানিন আরবিইন্ (أحمد رضا خان مصباح هندي بلسان عربي )
আল আযহারের আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের অধ্যাপক ড. রিজক মুরসী আবুল আব্বাস কর্তৃক ‘ভারতবর্ষের জ্ঞান জগতের উজ্জ্বল প্রদীপ ইমাম বেরলভীর আরবি ভাষায় তাঁর সুনিপুণ দক্ষতার বর্ণনা বিষয়ক অনন্য গ্রন্থ।
৮.মাওলানা আহমদ রেযা খান ওয়াল লুগাতুল আরবিয়া
( مولانا أحمدرضا خان واللغة العربية)
“আরবি ভাষা ও আহমদ রেযা” শীর্ষক গবেষণামূলক প্রবন্ধটি লিখেছেন আল আযহারের অধ্যাপক প্রফেসর ড. হোসাইন মুজিব আল মিসরী।
৯.মাওলানা আহমদ রেযা খান ওয়াল লুগাতুল আরবিয়া
(القاب مولانا الإمام عند علماء العرب)
আরব বিশ্বের ওলামা কেরামের নিকট ইমাম আহমদ রেযার ব্যক্তিত্ব ও অনন্য প্রতিভা বিভিন্ন সম্মানসূচক উপাধি ও অভিধায়ে ভূষিত। এ বিষয়ে প্রফেসর ড. হাযেম মাহফুজ কর্তৃক লিখিত প্রবন্ধ প্রনিধানযোগ্য।
১০.ইমামুল আরব ওয়াল আজম মাওলানা আহমদ রেযা খান আল বেরলভী
( إمام العرب والعجم مولانا أحمد رضا خان البريلوي)
আল আযহারের প্রফেসর ড. নবীলা ইসহাক চৌধুরী আরব ও অনারবীয়দের ইমাম আহমদ রেযা খাঁন বেরলভী (র.) সর্বজনগ্রাহ্য প্রতিভা ও অসাধারণ ব্যক্তিত্বের বর্ণনা বিষয়ক গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ।
১১.ওয়াজহুল হাজতি ইলা দারাসতি মাওলানা আহমদ রেযা খান ( وجه الحاجة إلى دراسة مولانا أحمد رضا خان)
প্রফেসর ড. হোসাইন মুজিব আল মিসরী মাওলানা আহমদ রেযার জীবন দর্শন চর্চার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা শীর্ষক প্রবন্ধ লিখেছেন।
আল-আযহারের খ্যাতিমান প্রফেসর প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ড. হোসাইন মুজিব আল মিসরী মাওলানা আহমদ রেযার গবেষণা কর্মের সাথে সম্পৃক্ত হওয়াটা কেবল মিসরবাসীদের জন্য গর্বের বিষয় নয়; বরং তা গোটা আরববাসীকে ইমাম আহমদ রেযার চিন্তাধারা ও দর্শনকে চর্চার প্রতি আহবান। ড.মুজিব মিসরী আরব বিশ্বের জ্ঞানী-গুণী পন্ডিত মহলে সর্বত্র সমাদৃত। মিসর আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়, কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়, আউনুশ শমস বিশ্ববিদ্যালয়সহ বহু ইউনিভার্সিটিতে তাঁর ছাত্রগণ লেকচারার ও প্রফেসর পদে অধিষ্ঠিত রয়েছেন। পৃথিবীর আটটি ভাষার উপর তাঁর অসামান্য দক্ষতা রয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় তাঁর রচিত গ্রন্থাবলীর সংখ্যা ষাটের অধিক। ইমাম আহমদ রেযার ফার্সি কাব্য সংকলন “আরমগানে রেযা” এর আরবি গদ্যানুবাদ করেছেন এই খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব প্রফেসর ড. হোসাইন মুজিব মিসরী। এছাড়া আরবি ফার্সী ও তুর্কী ভাষায় তাঁর আটটি কাব্য সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। প্রাচ্যের কবি ড. আল্লামা ইকবাল-এর পি-এইচ.ডি থিসিস তিনিই আরবিতে অনুবাদ করেছেন।
তাফসীর শাস্ত্রে অনন্য দক্ষতা
আ‘লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা (রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলাইহি) হলেন জ্ঞানের ইনসাইক্লোপিডিয়া। সত্তরাধিক বিষয়ে ব্যুৎপত্তি, দক্ষতা ও পাণ্ডিত্যের অধিকারী আ’লা হযরত সহস্রাধিক প্রামাণ্য গ্রন্থ-রচনা করেন। এ সব বিষয়ের প্রত্যেকটিতে আ‘লা হযরত এক বা একাধিক গ্রন্থ- রচনা করেছেন। তবে ‘তাফসীরে কোরআন’ বিষয়ের উপর তাঁর পৃথক কোন বড় ও স্বতন্ত্র গ্রন্থ পাওয়া না গেলেও আনুষঙ্গিক ও প্রাসঙ্গিকভাবে তিনি পবিত্র কোরআনের যেসব তাফসীর বা ব্যাখ্যা, তত্ব ও তথ্যাদি উল্লেখ করেছেন, সেগুলোর পাঠ-পর্যালোচনা করলে এ কথা মধ্যাহ্ন সূর্যের ন্যায় স্পষ্ট হয়ে যায় যে, আ‘লা হযরত একজন সুদক্ষ মুফাসসিরে কোরআনও ছিলেন। এ নিবন্ধে এতদসংক্রান্ত আলোচনার প্রয়াস পাবো। তাফসীর শাস্ত্রের ইমামগণ পবিত্র কোরআনুল কারীমের তাফসীরের ক্ষেত্রে চারটি পদ্ধতি বর্ণনা করেছেন। যথা-
(১) تفسير القرآن بالقرآن (তাফসীরুল কোরআন বিল কোরআন) তথা কোরআন দ্বারা কোরআনের ব্যাখ্যা।
(২) تفسير القرآن بالاحاديث (তাফসীরুল কোরআন বিল আহাদিস) তথা হাদিসসমূহ দ্বারা কোরআনের ব্যাখ্যা।
(৩) تفسير القرآن باثار الصحابة والتابعين (তাফসীরুল কোরআন বিআসারিস সাহাবা ওয়াত্ তাবেয়ীন) তথা সাহাবী ও তাবেয়ীগণের মতামত দ্বারা কোরআনের ব্যাখ্যা।
(৪)تفسير القرآن باللغة العربية والقواعد الإسلامية (তাফসীরুল কোরআন বিল-লুগাতিল আরাবিয়্যাহ ওয়াল কাওয়ায়িদিল ইসলামিয়্যাহ) তথা আরবি ভাষা ও ব্যাকরণ দ্বারা কোরআনের ব্যাখ্যা।
ইমাম আহমদ রেযা (রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলাইহি) তাঁর তাফসীর সংক্রান্ত আলোচনা উপরোক্ত যাবতীয় পদ্ধতির আলোকে বর্ণনা করেছেন। যা তাঁর এ বিষয়ে সুগভীর দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার প্রমাণ বহন করে।
(১) تفسير القرآن بالقرآن (তাফসীরুল কোরআন বিল কোরআন) তথা কোরআন দ্বারা কোরআনের ব্যাখ্যা:
কোরআনুল কারীমের এক আয়াত দ্বারা অন্য আয়াতের ব্যাখ্যা করার প্রক্রিয়াকে বলা হয় তাফসীরুল কোরআন বিল কোরআন বা কোরআন দ্বারা কোরআনের ব্যাখ্যা। কোরআনুল কারীমের কিছু আয়াত এমন যে, তা বারংবার ইরশাদ হয়েছে। আবার কিছু সামান্য পার্থক্য সহকারে অন্য স্থানে অবতীর্ণ হয়েছে। তাফসীরের সময় ঐ আয়াতগুলোতে দৃষ্টি রাখা জরুরী। কেননা, এক আয়াত অন্য আয়াতের ব্যাখ্যা করছে। যাতে কোরআনুল কারীমের উদ্দেশ্য ও মহান রবের অভিপ্রায় সুস্পষ্ট ও পরিষ্কার হয়ে যায়। এ রকম অগণিত দৃষ্টান্ত ইমাম আহমদ রেযা (রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলাইহি)’র অসংখ্য গ্রন্থে বিদ্যমান রয়েছে। এখানে শুধুমাত্র একটি উদাহরণ পেশ করছিÑ ইমাম আহমদ রেযা (রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলাইহি) হুযুর সায়্যিদে আলম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)’র প্রেরণের ব্যাপকতা বর্ণনায় এক আয়াত উপস্থাপন করেন,
وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا كَافَّةً لِّلنَّاسِ بَشِيرًا وَنَذِيرًا وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ.
Ñএবং হে মাহবুব! আমি আপনাকে প্রেরণ করিনি, কিন্তু এমন এক রিসালাত সহকারে, যা সমস্ত মানবজাতিকে পরিব্যাপ্ত করে নেয়, সুসংবাদদাতা এবং সতর্ককারী; কিন্তু অনেকেই জানেনা।
এই আয়াতের ব্যাখ্যা ও সুস্পষ্ট বিবরণ দিতে গিয়ে তিনি অন্য আয়াত পেশ করেন। যথাÑ
تَبَارَكَ الَّذِي نَزَّلَ الْفُرْقَانَ عَلَى عَبْدِهِ لِيَكُونَ لِلْعَالَمِينَ نَذِيرًا.
অত্যন্ত মঙ্গলময় তিনি, যিনি অবতীর্ণ করেছেন ক্বোরআন, আপন খাস বান্দার প্রতি, যাতে তিনি সমগ্র জগতের জন্য সতর্ককারী হন।
প্রথম আয়াতে হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সমস্ত মানুষের জন্য প্রেরণ হওয়া বুঝায়, কিন্তু অন্য আয়াত হতে স্পষ্ট হয়ে গেল যে, তিনি (শুধুমাত্র মানবজগতের জন্য নয়, বরং) সমস্ত জগতের জন্য রাসূল। এবার ইমাম আহমদ রেযা (রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলাইহি)’র এই ব্যাখ্যার বিবরণ শুনুন। তিনি বলেন, হুযুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)কে সমস্ত জিন ও ইনসানের রাসূল হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে। এই ‘মহান রিসালত’-এ সকল জিন ও ইনসান অন্তর্ভুক্ত হওয়ার ব্যাপারে ঐক্যমত্য রয়েছে এবং মুহাক্কিকীনের নিকট ফেরেশতাগণও এর অন্তর্ভুক্ত। এ ব্যাপারে আমি (আ‘লা হযরত) আল্লাহ তা‘আলার তাওফীকক্রমে আমার রচিত কিতাব اجلال جبريل (ইজলালে জিবরীল)-এ বিশদ আলোচনা করেছি। সারসংক্ষেপ কথা হলোÑ গাছ-পালা, পাথর-মাটি, আসমান-যমীন, পাহাড়-সাগর, এক কথায় আল্লাহ ব্যতীত সমগ্র সৃষ্টিরাজি এতে সন্নিবেশিত রয়েছে। তাইতো কোরআনুল কারীমে হুযুরের শ্রেষ্ঠত্বের ব্যাপারে عالمين (আলামীন) শব্দের প্রয়োগ হয়েছে। (যা আল্লাহ ব্যতীত সবকিছুকে অন্তর্ভুক্ত করে) আর সহীহ মুসলিম শরীফের হাদিসে خلق (খলকুন) শব্দটি এসেছে তাও তাগীদসূচক كافة (কাফফাতুন) শব্দ দ্বারা। হাদিসটি হলোÑ ارسلت الي الخلق كافة আমি গোটা সৃষ্টিজগতের জন্য প্রেরিত।
(২) تفسير القرآن بالاحاديث (তাফসীরুল কোরআন বিল আহাদিস) তথা হাদিসসমূহ দ্বারা কোরআনের ব্যাখ্যা:
কাফের-মুশরিকগণের নিকট সাহায্য চাওয়া হারাম এটা প্রমাণ করার জন্য ইমাম আহমদ রেযা (রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলাইহি) তাঁর রচিত الحجة المؤتمنة (আল-হুজ্জাতুল মু’তামিনা) গ্রন্থে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। হাদিসে পাকের আলোকে বিস্তৃত বর্ণনা দিয়েছেন। আবার প্রত্যেক হাদিসের বিশুদ্ধতার বর্ণনা, বর্ণনাকারীর নির্ভরযোগ্যতা, ন্যায়পরায়ণতা ইত্যাদিতেও পরিপূর্ণ দৃষ্টিপাত করতেন। এক্ষেত্রেও তাঁর দক্ষতা প্রস্ফুটিত হয়। যেমনÑ কাফেরদের নিকট সাহায্য চাওয়া নিষিদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে অসংখ্য আয়াত রয়েছে। তন্মধ্যে একটি হলো,لاَّ يَتَّخِذِ الْمُؤْمِنُونَ الْكَافِرِينَ أَوْلِيَاء مِن دُوْنِ الْمُؤْمِنِينَ وَمَن يَفْعَلْ ذَلِكَ فَلَيْسَ مِنَ اللّهِ فِي شَيْءٍ Ñমুসলমানগণ যেন কাফেরদের আপন বন্ধু না বানিয়ে নেয়, মুসলমানগণ ব্যতীত। আর যে ব্যক্তি এরূপ করবে, আল্লাহর সাথে তার কোনো সম্পর্ক রইলো না। এবার এই আয়াতের ব্যাখ্যায় হাদিসে পাকের প্রতি দৃষ্টিপাত করি। হাদিসটি হলো, হযরত আবু হুমাইদ সাঈদী (রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু) হতে বর্ণিত যে, আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) উহুদ যুদ্ধের দিন তাতে গমন করেন। যখন ‘ছানিয়াতুল বিদা’ উপত্যকা অতিক্রম করলেন, তখন একটি শক্তিশালী সৈন্যদল দেখতে পেলেন। তিনি বললেন, এরা কারা? সাহাবায়ে কেরামগণ বললেন, তারা হলো বনু কাইনুকা এবং আব্দুল্লাহ বিন সালামের অনুসারী। তিনি বললেন, তাঁরা কি আমাদের ইসলামকে স্বীকার করে? তারা বললেন, না, নিশ্চয় তারা তাদের ধর্মের উপর অটল রয়েছে। নবী পাক (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, তোমরা তাদেরকে বলে দাও যে, তারা যেন ফিরে যায়, নিশ্চয় আমরা মুশরিকদের সাহায্য কামনা করি না।
(৩) تفسير القرآن باثار الصحابة والتابعين (তাফসীরুল কোরআন বিআসারিস সাহাবা ওয়াত তাবেয়ীন) তথা সাহাবী ও তাবেয়ীগণের মতমত দ্বারা কোরআনের ব্যাখ্যা:
এ পদ্ধতির সাথে সংশ্লিষ্ট তাফসীরের আলোচনা ইমাম আহমদ রেযা (রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলাইহি)’র বহু গ্রন্থে বিদ্যমান। যখন তিনি কোরআনুল কারীমের কোনো আয়াত নিয়ে আলোচনা করতেন তখন তার ব্যাখ্যায় রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)’র হাদিসে পাক, সাহাবায়ে কেরামের মতামত এবং তাবেয়ীগণের বাণীর আলোকে খুব চমৎকারভাবে এবং সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করতেন। কোনো আয়াত মনসুখ (রহিত) কিংবা মুহকাম (সুস্পষ্ট) এর ব্যাপারে নিজস্ব মতামতের ভিত্তিতে নয়; বরং তা অন্য কোনো আয়াতে কারীমা অথবা হাদিসে পাকের আলোকে করতেন, অতঃপর সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীনে এজামদের আসারের ভিত্তিতে করতেন। এমন আয়াত যার অর্থ পরস্পর বিপরীত হয়। তখন এটাই প্রতীয়মান হয় যে, তাদের উদ্দেশ্য ভিন্ন। এভাবে এক আয়াত ‘মনসুখ’ (রহিত) হয় এবং অন্যটি ‘নাসেখ’ (রহিতকারী) হয়ে থাকে এবং এসব বিষয়ের জ্ঞান উল্লেখিত উত্তম পদ্ধতির মাধ্যম হিসেবে বিবেচ্য। ইমাম আহমদ রেযা (রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলাইহি) এই সমস্ত আলোচনার সাথে সম্পৃক্ত বিষয়সমূহ তাঁর গ্রন্থাবলিতে উল্লেখ করেছেন এবং গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় বিষয়াদি একত্রিত করেছেন। তন্মধ্যে একটি উদাহরণ নিম্নে পেশ করা হলো। উদাহরণ: سِيمَاهُمْ فِي وُجُوهِهِم مِّنْ أَثَرِ السُّجُودِ Ñতাদের চিহ্ন হচ্ছে তাদের চেহারার সাজদার চিহ্ন থাকে। ইমাম আহমদ রেযা (রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলাইহি) বলেন, সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীনে এজাম এই ‘দাগ’ এর ব্যাখ্যায় চারটি মতামত ব্যক্ত করেছেন। সেগুলো হলোÑ প্রথমত: কিয়ামত দিবসে সাজদার বরকতে তাদের চেহারায় সেই নূর প্রকাশ পাবে। এটা হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ, ইমাম হাসান বসরী, আতিয়া মওফী, খালিদ হানাফী এবং মুকাতিল ইবনে হায়য়ান (রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুম) হতে বর্ণিত। দ্বিতীয়ত: নম্র, বিনয়ী, সদ্ব্যবহারের প্রভাব দুনিয়ার মধ্যে সালিহীনের চেহারায় বানোয়াট ব্যতীত প্রকাশ পায়। তা হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস ও ইমাম মুজাহিদ (রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা)’র অভিমত। তৃতীয়ত: রাত্রি জাগরণ তথা কিয়ামুল লায়ল এর কারণে চেহারা হলুদ রং ধারণ করা। তা ইমাম হাসান বসরী, দ্বাহহাক, ইকরামা, শিমর বিন আত্বিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুম) হতে বর্ণিত। চতুর্থত: তা হলো অযুর পানির আর্দ্রতা ও মাটির প্রভাব, যা যমীনে সাজদা করার কারণে নাকে ও কপালে লেগে যায়। এটা হযরত ইমাম সাঈদ বিন জুবাইর ও হযরত ইকরামা (রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুমা)’র অভিমত। এ চারটি মতামত ব্যক্ত করার পর তিনি (আ‘লা হযরত) বলেন, এ চারটি অভিমতের মধ্যে প্রথম দুটি প্রণিধানযোগ্য ও শক্তিশালী। এ দুটোর ব্যাপারে সরাসরি নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)’র হাদিস বর্ণিত রয়েছে। তা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হতে হাসান পর্যায়ের সনদ দ্বারা সাব্যস্ত, যা ইমাম তবরানী (রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলাইহি) তাঁর লিখিত মু‘জাম-ই আওসাত ও সগীর এবং ইবনে মারদূভীয়া হযরত উবাই ইবনে কা‘ব (রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু) হতে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেন, আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আল্লাহর বাণীÑ سِيمَاهُمْ فِي وُجُوهِهِم مِّنْ أَثَرِ السُّجُودِ -এর ব্যাপারে বলেছেন, اَلنُّوْرُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ Ñ‘কিয়ামত দিবসের নূর’ উদ্দেশ্য। তাইতো ইমাম জালালুদ্দীন মহল্লী (রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলাইহি) এ কথার উপর সম্মতি জ্ঞাপন করেছেন। আমি বলছি তৃতীয় অভিমতটি ঈষৎ দুর্বল। কপালের দাগ রাত্রি জাগরণের চিহ্ন, সাজদার চিহ্ন নয়। সাজদার উদ্দেশ্যে রাত্রি জাগরণ পাওয়া গেলে সঠিক হয়। চতুর্থ অভিমত একেবারে দুর্বল। অযুর পানি সাজদার চিহ্ন নয়। নামাযের পর কপালের মাটি ঝেড়ে ফেলার হুকুম রয়েছে। সাজদার চিহ্ন বা سِيمَا হলে তাকে দূর করার বিধান আসতো না। মনে হয় ঐ অভিমত সাঈদ বিন জুবাইর (রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু) হতে সাব্যস্ত নয়। বস্তুতঃ কতেক মানুষের অধিক সাজদার কারণে যে কাল দাগ পড়ে নবীর হাদিসে তার ভিত্তি নেই। বরং হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস, সায়িব বিন ইয়াযিদ ও মুজাহিদ (রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুম) এ ধরনের হাদিসকে অস্বীকার করেন।
(৪) تفسير القرآن باللغة العربية والقواعد الإسلامية (তাফসীরুল কোরআন বিল-লুগাতিল আরাবিয়্যাহ ওয়াল কাওয়ায়িদিল ইসলামিয়্যাহ) তথা আরবি ভাষা ও ব্যাকরণ দ্বারা কোরআনের ব্যাখ্যা
আরবি ভাষা ও ব্যাকরণেও ইমাম আহমদ রেযা (রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলাইহি) পূর্ণ দক্ষতার অধিকারী ছিলেন। বিভিন্ন উসূল ও কাওয়ায়েদের সাথে সম্পর্কিত স্বতন্ত্র অনেক কিতাবও তিনি রচনা করেন। তাঁর রচনাবলীতে ভাষার জ্ঞান, বিষয়ভিত্তিক নিয়মাবলী, যুক্তি-তর্ক ছাড়াও আকলী ও নকলী উভয় ধরনের জ্ঞান বিতরণে তিনি সিদ্ধহস্ত ছিলেন। ইলমে নাহ্ভ ও ইলমে সরফের নিয়মাবলী, ইলমে মা‘আনী, ইলমে বয়ান, ইলমে বদী, উসূলুত্ তাফসীর, উসূলুল হাদিস, উসূলুল ফিক্হ ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উৎপত্তি তো কোরআন-হাদিস বুঝা এবং বুঝানোর জন্যই হয়েছে। আর মুফাসসির, মুহাদ্দিস, ফুকাহা ও মুজতাহিদগণের জ্ঞানের স্রোতধারা এই জ্ঞানসমূহ হতে উৎসারিত। এ কারণে কোরআনুল কারীমের তাফসীরের সময় তাতে দৃষ্টিপাত করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইমাম আহমদ রেযা (রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলাইহি) এই পদ্ধতিতে তাফসীর উপস্থাপন করতেন, যাতে কোরআনুল কারীমের সূক্ষ্ম রহস্য উদঘাটন হতো এবং মহান রবের অতুলনীয় মর্যাদা উপস্থাপিত হতো। নিম্নে তার প্রকৃষ্ট একটি উদাহরণ পেশ করছি। যথাÑ মহান আল্লাহ হুযুর পুরনূর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)কে সমস্ত আম্বিয়া (আলাইহিমুস সালাম) হতে শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী ও অতুলনীয় মর্যাদাসম্পন্ন করেছেন। কোরআনে পাকের অসংখ্য আয়াতে কারীমায় তা ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে বর্ণিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)’র সুউচ্চ মর্যাদা সম্বন্ধে আল্লাহর আকাক্সক্ষা তাতো সম্পূর্ণ কোরআন জুড়েই বিদ্যমান। মহান আল্লাহ ইরশাদ করছেন,
وَإِذْ أَخَذَ اللّهُ مِيثَاقَ النَّبِيِّيْنَ لَمَا آتَيْتُكُم مِّن كِتَابٍ وَحِكْمَةٍ ثُمَّ جَاءكُمْ رَسُولٌ مُّصَدِّقٌ لِّمَا مَعَكُمْ لَتُؤْمِنُنَّ بِهِ وَلَتَنصُرُنَّهُ قَالَ أَأَقْرَرْتُمْ وَأَخَذْتُمْ عَلَى ذَلِكُمْ إِصْرِي قَالُواْ أَقْرَرْنَا قَالَ فَاشْهَدُواْ وَأَنَاْ مَعَكُم مِّنَ الشَّاهِدِينَ.
Ñএবং স্মরণ করুন! যখন আল্লাহ নবীগণের নিকট থেকে তাদের অঙ্গিকার নিয়েছিলেন। “আমি তোমাদেরকে যে কিতাব ও হিকমত প্রদান করবো, অতঃপর তাশরীফ আনবেন তোমাদের নিকট রাসূল, যিনি তোমাদের কিতাবগুলো সত্যায়ন করবেন, তখন তোমরা তাঁর প্রতি ঈমান আনবে এবং নিশ্চয় নিশ্চয় তাকে সাহায্য করবে।” এরশাদ করলেন, “তোমরা কি স্বীকার করলে এবং এ সম্পর্কে আমার গুরুদায়িত্ব গ্রহণ করলে?” সবাই আরজ করলো, “আমরা স্বীকার করলাম।” এরশাদ করলেন, “তবে (তোমরা) একে অপরের উপর সাক্ষী হয়ে যাও। এবং আমি নিজেই তোমাদের সাথে সাক্ষীদের মধ্যে রইলাম।
উক্ত আয়াতে হুযুরে আকরাম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)’র ব্যাপক ফযিলতের উপর বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়েছে। পরিশেষে (মহান আল্লাহর কৃপায় আমি বলছি) আবার এটাও দেখা যায় যে, উক্ত প্রসঙ্গটি পবিত্র কোরআন মাজীদে কিরূপ গুরুত্বের সাথে বর্ণনা করা হয়েছে এবং বারংবার তাগীদ দেওয়া হয়েছে।
প্রথমত: আম্বিয়া আলাইহিমুস সালাম নিষ্পাপ। আল্লাহর আদেশের পরিপন্থী কোনো কাজ তাদের থেকে প্রকাশিত হয় না যে, মহান রব নির্দেশ সূচকভাবে তাদের বলেছেন, যদি ঐ নবী তোমাদের কাছে আসেন তাঁর উপর ঈমান আনবে এবং তাকে সাহায্য করবে, কিন্তু তার উপর যথেষ্ট করেননি বরং তাদের থেকে অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতি নিয়েছেন। এই অঙ্গীকার (الست بربكم) “আমি কি তোমাদের রব নই?” মহান রবের সাথে কৃত অঙ্গিকারের বিষয়টি এমনভাবে সংযুক্ত ছিল, যেভাবে কালিমা-ই لا اله الا الله এর সাথে محمد الرسول الله সংযুক্ত রয়েছে। যেন প্রকাশ পায় যে, আল্লাহ ব্যতীত অন্য সবকিছুর জন্য প্রথম আবশ্যকীয় কর্তব্য হলো আল্লাহর রুবুবিয়্যতের উপর আস্থা রাখা। আল্লাহর পরই সাথে সাথে পেয়ারা নবী হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)’র রিসালাতের উপর ঈমান আনা। দ্বিতীয়ত: ঐ চুক্তিতে ‘লামে কসম’ (لام قسم) দ্বারা দৃঢ়তা প্রদান করা হয়েছে। لَتُؤْمِنُنَّ بِهِ وَلَتَنصُرُنَّهُ Ñ“তখন তোমরা তাঁর প্রতি ঈমান আনবে এবং নিশ্চয় নিশ্চয় তাকে সাহায্য করবে।” যেভাবে নবাবগণ (রাজ্যের শাসক) বাদশাহদের থেকে অঙ্গিকার নিয়ে থাকেন। ইমাম সুবকী (রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলাইহি) বলেন, মাসআলা: বায়‘আত এই আয়াত হতে গৃহীত হয়েছে। তৃতীয়ত: নূনে তাকিদ (نون تاكيد) বা দৃঢ়তাসূচক নূন। চতুর্থত: তাও নূনে সক্বিলাহ (نون ثقيلة) বা তাশদীদবিশিষ্ট দৃঢ়তাসূচক নূন এনে তাগিদ তথা দৃঢ়তাকে দ্বিগুণ করা হয়েছে। পঞ্চমত: এই পরিপূর্ণ ব্যবস্থাপনায় দেখুন যে, সম্মানিত নবীগণ এখনো জবাব দিতে পারেননি, স্বয়ং আল্লাহই আগে জিজ্ঞেস করে বসলেন, আ-আক্বরারতুম (أَأَقْرَرْتُمْ) Ñতোমরা আমার এ ব্যাপারে স্বীকৃতি দিচ্ছ কি? অর্থাৎ, এর দ্বারা পূর্ণতা, দ্রুততা ও ধারাবাহিক অনুমোদন উদ্দেশ্য। ষষ্ঠত: এতটুতেও যথেষ্ট করেননি বরং বলেছেন, وَأَخَذْتُمْ عَلَى ذَلِكُمْ إِصْرِي Ñ“আমার শুধু স্বীকৃতিই নয়; বরং এটার উপর আমার গুরুদায়িত্ব বুঝে নাও ।” সপ্তমত: আলাইহি (عليه) অথবা আলা হাযা (علي هذا) এর স্থলে আলা যালিকুম (على ذلكم) বলেছেন, ইঙ্গিতের পরেও মর্যাদা যাতে অটুট থাকে। অষ্টমত: আরো উন্নতি হলো যে, ফাশহাদু (فَاشْهَدُواْ) Ñতোমরা সাক্ষী হয়ে যাও একজন আরেকজনের উপর। যদিও (আল্লাহর পানাহ) প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করা পূতঃপবিত্র মহান ব্যক্তিদের জন্য যৌক্তিক ছিল না। নবমত: পরিপূর্ণতা এটাই যে, শুধুমাত্র তাঁদের সাক্ষ্যের উপর যথেষ্ট হয়নি, বরং ইরশাদ করেছেন, وَأَنَاْ مَعَكُم مِّنَ الشَّاهِدِينَ Ñ“আর আমি নিজেও তোমাদের সাথে সাক্ষী হিসেবে রইলাম।” দশমত: সবচেয়ে সূক্ষ্ম ও চূড়ান্ত বিষয় এটাই যে, ঐ মহান দৃঢ়তা জ্ঞাপনের পর সুদৃষ্টির সাথে আম্বিয়া (আলাইহিমুস সালাম)’র নিষ্কলুষতা দান করার ঘোষণার পর অমান্যকারীদের প্রতি জোরালো ধমকও দেয়া হয়েছে, فَمَن تَوَلَّى بَعْدَ ذَلِكَ فَأُوْلَـئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ সুতরাং যে কেউ এরপর ফিরে যাবে, তবে সেসব লোক ফাসিক্ব। আর যে ব্যক্তি ঐ স্বীকৃতি প্রত্যাখ্যান করবে সে ফাসিক্বে (পাপাচারীতে) পরিণত হয়ে যাবে। আল্লাহর এই আয়োজন ও ব্যবস্থাপনা, যা মহান রবের পক্ষ হতে গৃহীত হয়েছে যে, নিষ্পাপ ফেরেশতাগণের ব্যাপারে আল্লাহ বলছেন,
وَمَن يَقُلْ مِنْهُمْ إِنِّي إِلَهٌ مِّن دُونِهِ فَذَلِكَ نَجْزِيهِ جَهَنَّمَ كَذَلِكَ نَجْزِي الظَّالِمِينَ.
Ñতাদের মধ্যে কেউ বলে, আমি (আল্লাহ) ব্যতীত উপাস্য, তবে আমি তাকে জাহান্নামের শাস্তি দেব। আমি এভাবেই যালিমদেরকে শাস্তি দিয়ে থাকি।
তাদের মধ্যে যে ব্যক্তি বলবে, আল্লাহর সমকক্ষ মা’বুদ আছে, তাকে জাহান্নামের শাস্তি দেওয়া হবে। আমি এমনভাবেই শাস্তি প্রদান করব। এখানে অপরাধীদের যেনো ইঙ্গিত করেছেন, যেভাবে আমাদের ঈমানের প্রথম অংশ ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ (لا اله الا الله)’র বিষয় রয়েছে, একইভাবে দ্বিতীয়াংশে ‘মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ’ (محمد الرسول الله) রয়েছে। এটাকে পূর্ণতা দেওয়া হয়েছে যে, আমি সমগ্র জগতের রব, নৈকট্যধন্য ফেরেশতাকুলও আমার ইবাদত থেকে শির ফেরাতে পারে না। আর আমার মাহবুব হলেন, সমগ্র জগতের রাসূল এবং অনুকরণীয় যে, নবী-রাসূলগণও তাঁর সেবার গণ্ডিতে প্রবিষ্ট হয়েছেন। (আল্লাহর জন্যই সমস্ত প্রশংসা, নবী পাকের সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর দুরূদ।) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)’র সুউচ্চ মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনায় উপরোক্ত দলীল থাকা সত্ত্বেও অন্য প্রমাণের কি প্রয়োজন?
মোদ্দাকথা, আ‘লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা (রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলাইহি) তাফসীর শাস্ত্রে পূর্ণ দক্ষতা রাখেন এবং তাফসীর শাস্ত্রের যাবতীয় নীতিমালা ও পদ্ধতি সম্পর্কে গভীর জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। তাফসীর শাস্ত্রের আলোকে কোরআনের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, যথাযথ মর্মার্থ নিরূপণ, মুসলিম উম্মাহর ঈমান-আক্বিদা সংরক্ষণ এবং কোরআন-সুন্নাহর অপব্যাখ্যা ও বিকৃতকারীদের স্বরূপ উম্মোচনে তিনি অনন্য অবদান রাখেন। অনেকে তাফসীর শাস্ত্রে ইমাম আহমদ রেযা (রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলাইহি)’র অবদান ও ভূমিকা মানতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে থাকে। ইমাম আহমদ রেযা (রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলাইহি)’র ব্যাপারে তাদের এ ধারণা নিছক অজ্ঞতা ও বিদ্বেষ প্রসূত। ইমাম আহমদ রেযা (রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলাইহি)’র রচনাবলী সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকার কারণে এ জাতীয় অবান্তর মন্তব্য করার মূল কারণ। তাফসীর শাস্ত্রে ইমাম আহমদ রেযা (রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলাইহি)’র জ্ঞান গভীরতা ও পরিধি কতো বিস্তৃত তা তাঁর রচিত গ্রন্থাবলী মনযোগ সহকারে অধ্যায়ন করলেই অনুমেয় হবে।
হারামাঈন শরীফাঈনে আ’লা হযরত চর্চা
আ’লা হযরত সর্বপ্রথম ২৩ বৎসর বয়সে নিজ পিতা মাতার সাথে ১২৯৬ হি. (১৮৭৮খ্রি.) হজ্জে বায়তুল্লাহ ও যিয়ারতে মুস্তফার লক্ষ্যে হারামাঈন শরীফাঈনে গমন করেন। ১৩২৩ হি. (১৯০৫ খ্রি.) বড় ছাহেবজাদা হুজ্জাতুল ইসলাম মুফতি হামেদ রেযা খান কাদেরী (রহ.) কে সাথে নিয়ে হজ্জে বায়তুল্লাহ ও যিয়ারতে মুস্তফা সম্পন্ন করেন। এ বারে তিনি মক্কা শরীফে তিনমাস মদীনা মুনাওয়ারা শরীফে একত্রিশ দিন অবস্থানের সৌভাগ্য অর্জন করেন। এ সুদীর্ঘ সময় অবস্থানকালে সেখানকার আরব বিশ্বের খ্যাতিনামা ওলামায়ে কেরাম তাঁকে প্রাণঢালা অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করেন। শরয়ী বিভিন্ন জটিল কঠিন বিষয়াদি ও আকাইদ সংক্রান্ত বিষয়াদি নিয়ে আ’লা হযরত থেকে হাদীসের সনদ গ্রহণ করেন। আ’লা হযরতের প্রজ্ঞাপূর্ণ ও জ্ঞানগর্ভ আলোচনায় তাঁরা মুগ্ধ হন। তাঁর ইলমী গভীরতা ও ফতোয়া প্রণয়নের দক্ষতায় তাঁরা বিস্মিত হন। কতিপয় পথভ্রষ্ট সম্প্রদায় কর্তৃক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর শানে মানহানিকর, আপত্তিকর ধৃষ্টতাপূর্ণ ঈমান বিধ্বংসী বক্তব্য ও মন্তব্যের কারণে ইসলামি শরীয়তের আলোকে আ’লা হযরত “আল মুতামাদ আল মুস্তানাদ” ফাতওয়া গ্রন্থ রচনা করে তাদের প্রতি কুফুরি ফাতওয়া ব্যক্ত করেন, আ’লা হযরত প্রদত্ত এই ঐতিহাসিক ফাতওয়া হেরামাঈন শরীফাঈনের উচ্চ পর্যায়ের ওলামায়ে কেরামের সামনে পেশ করা হলে, ত্রিশের অধিক খ্যাতিসম্পন্ন উঁচুমানের বিজ্ঞ আলেম আ’লা হযরতের প্রদত্ত ফাতওয়ার সাথে ঐকমত্য পোষণ করেন এবং তাঁরা প্রত্যেকে লিখিতভাবে অভিমতপ্রদান করেন। নবীদ্রোহী ওহাবী নজদীদের উত্তরসূরী দেওবন্দী বাতিলদের স্বরূপ উন্মোচনে আ’লা হযরতের সাহসী ভূমিকাকে তাঁরা অভিনন্দন জানিয়েছেন। হেরামাঈন শরীফাঈনের ওলামায়ে কেরামের অভিমত সম্বলিত এ ফাতওয়া গ্রন্থটি ১৩২৪ হিজরী সনে “হুসামুল হারামাঈন আলা মানহারিল কুফুরি ওয়াল মায়ান” নামে প্রকাশিত হয়। যা ১৪১৭ হিজরী মোতাবিক ১৯৯৬ সনে ‘কুফর ও মিথ্যার গ্রীবাদেশে হেরামাঈন শরীফাঈন এর শাণিত তরবারী’ নামে অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুল করিম নঈমী কাদেরী কর্তৃক অনূদিত ও প্রকাশিত হয়। আ’লা হযরত (রহ) মক্কা মুকাররমায় অবস্থানকালে প্রখ্যাত আলেমেদ্বীন শায়খ আব্দুল্লাহ আবুল খায়র মিরদাদ (র.) অসংখ্যবার তাঁর সান্নিধ্য অর্জন করেন। ‘আদ্দৌলাতুল মাক্কিয়াহ’ প্রকাশকালে আ’লা হযরতের সাথে সম্পর্ক সূদৃঢ় হয়। একদিন শায়খ আব্দুল্লাহ মিরদাদ এবং শায়খ মুহাম্মদ আহমদ হামিদি আদাভী কাগজের নোট সম্পর্কে বারটি প্রশ্ন সম্বলিত আবেদন পেশ করেন তদুত্তরে আ’লা হযরত (র.) ‘কিফলুল ফকিহিল ফাহিম ফী আহকামি কিরতাসিদ দিরাহিম’ গ্রন্থ রচনা করেন।
শায়খ আল্লামা আবুল খায়ের বিন আব্দুল্লাহ মিরদাদ মসজিদে হেরেমের সম্মানিত খতিব এর অভিমত, নি:সন্দেহে তিনি (ইমাম আহমদ রেযা) বিজ্ঞ পন্ডিত, যিনি স্বীয় নয়নের জ্যোতিতে জটিল কঠিন বিষয়াদি সমাধানে সক্ষম। আহমদ রেযা যিনি তাঁর নামের স্বার্থক বাহক, তাঁর কথামালা মুনিমুক্তা সদৃশ্য, তিনি সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়াবলীর আকর। তাঁর জ্ঞান প্রজ্ঞা সংরক্ষিত ভান্ডার হতে নির্বাচিত মারিফাতের সূর্য, যা দিবালোকের ন্যায় দীপ্তমান। যিনি জ্ঞানসমূহের জাহের-বাতেন উন্মোচনকারী। তাঁর সম্পর্কে যার অবগতি রয়েছে তার জন্য এ মন্তব্য করা উচিত যে, তিনি পূর্ববর্তী ও পরবর্তীদের জন্য অনেক কিছু রেখে গেছেন। অতঃপর নিমোক্ত পংক্তি বর্ণনা করেন,
ليس على الله بمستنكر + أن يجمع العالم في واحد
“আল্লাহর জন্য কঠিন নয় যে, তিনি একজন ব্যক্তির মধ্যে সমগ্র পৃথিবী একত্রিত করে দেবেন।”
মক্কা মুকাররমার প্রখ্যাত আলেম আল্লামা শায়খ সৈয়দ মুহাম্মদ আলভী মালেকী আ’লা হযরত সম্পর্কে নিম্মোক্ত অভিমত ব্যক্ত করনে-১৫
نحن نعرفه بتصنيفاته وتا ليفا ته حبه علامة السنة وبغضه علامة البدعة
“আমরা তাঁকে তাঁর রচনাবলীর ও সংকলিত গ্রন্থাবলীর দ্বারা চিনতে পেরেছি। তাঁর প্রতি ভালবাসা সুন্নতের নিদর্শন। তাঁর প্রতি বিদ্বেষ পোষণ বিদআতীর লক্ষণ।”
আরব বিশ্বের ওলামা কেরামের অভিমত সম্বলিত আ’লা হযরত প্রণীত কিতাবাদি যা অনাদিকাল আরব বিশ্বে সুন্নীয়তের আদর্শ ও শিক্ষার প্রসারে দিশারীর ভূকিমা পালন করবে।
ইসলামী দুনিয়ায় তাঁর এ অসাধারণ ইলমী খিদমত অক্ষত ও অম্লান হয়ে থাকবে।