Table of Contents
মাজমূ‘আহ্ সালাওয়াতির রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আ-লিহী ওয়া আসহা-বিহী ওয়াসাল্লাম (আরবি-বাংলা)
লেখকঃ হজরত খাজা আবদুর রহমান চৌহরভী
মাজমূ‘আহ্ সালাওয়াতির রসূল-এর বৈশিষ্ট্যাবলী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আ-লিহী ওয়া আসহা-বিহী ওয়াসাল্লাম। পূর্ণ নাম- মুহায়্যিরুল উকূল ফী বায়ানি আওসাফি আকলিল উকূল আল্ মুসাম্মা বিমাজমুআতি সালাওয়াতির রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আ-লিহী ওয়াসাল্লাম। রচয়িতা শায়খুল মাশায়েখ, ওয়াকেফে আসরারে মা‘রিফাত, খাজায়ে খাজেগান, খলীফায়ে শাহে জীলান, মা‘আরেফে রব্বানীর ধারক, লদুনী ইলমের বাহক, খাজা আবদুর রহমান চৌর্হভী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু (১৮৪৩-১৯২৩খ্রি.)। আঙ্গিক সৌষ্ঠব ৩০ পারা বা খণ্ডে বিন্যস্ত। প্রতি পারা ৪৮ পৃষ্ঠা সম্বলিত সর্বমোট ১৪৪০ পৃষ্ঠায় রচিত (৩য় সংস্করণ)। রচনাকাল ১২ বছর ৮ মাস ২০ দিনে রচনা সম্পন্ন হয়। ২০ শতকের গোড়ার দিকে রচয়িতার জীবদ্দশায় পাণ্ডুলিপি রচিত হলেও বিষয়টি প্রকাশ হয় তার ওফাত পরবর্তী সময়ে।
১ম সংস্করণ:
পীরের নির্দেশে প্রধান খলিফা পেশোয়ায়ে আহলে সুন্নাত আলে রসূল আল্লামা হাফেজ ক্বারী সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি’র উদ্যোগে ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে মরহুম শেঠ আহমদের অর্থায়নে রেঙ্গুন থেকে প্রকাশিত হয়। এর ভূমিকা লিখেন আল্লামা ইসমাতুল্লাহ্ সিরিকোটী। এ ভূমিকায় বর্ধিত সংযোজনা আরোপ করেন শাহেনশাহে সিরিকোট রাহমাতুল্লাহি আলাইহি।
২য় সংস্করণ:
১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দ মোতাবেক ১৩৭২ হিজরি শাহেনশাহে সিরিকোট রাহমাতুল্লাহি আলাইহি’র উদ্যোগে মাওলানা আমীর শাহ্ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি’র তত্ত্বাবধানে চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত হয়।
৩য় সংস্করণ:
মুর্শেদে বরহক আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ রহমাতুল্লাহি আলাইহি’র নির্দেশনায় আন্জুমান-এ-রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া, চট্টগ্রাম থেকে প্রায় পাঁচ লক্ষাধিক টাকা ব্যয়ে ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দ মোতাবেক ১৪০২ হিজরিতে পাঁচ হাজার কপি ছাপানো হয়।
৪র্থ সংস্করণ:
পরবর্তীতে দরবারে আলিয়া সিরিকোট শরীফের বর্তমান সাজ্জাদানশীন আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তাহের শাহ্ ও অনুজ আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ সাবির শাহ্ মাদ্দাজিল্লুহুমাল আলী’র পৃষ্ঠপোষকতায় এর অনুবাদসহ চৌর্হ শরীফ পাকিস্তান হতে অফসেট কাগজে এর নবতর সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে মোতাবেক ১৪১৬ হিজরিতে। এটার উর্দূ অনুবাদ করেন প্রখ্যাত উর্দূ সাহিত্যিক আল্লামা আবুল হাসানাত মুহাম্মদ আশরাফ সিয়ালভী। এ মহান গ্রন্থ ছাপার সম্পূর্ণ খরচ বহন করেন আবুধাবী প্রবাসী, হাটহাজারী চট্টগ্রাম নিবাসী আলহাজ্ব আব্দুল জব্বার প্রকাশ ইউনুছ কোম্পানী।
মাজমু‘আহ্-এ সালাওয়াতে রসূল কিতাবের বৈশিষ্ট্য: আঙ্গিক বিন্যাসে কোরআন-হাদীসের সাদৃশ্য রক্ষা: পবিত্র কোরআনে মজীদ এবং হাদীসের জগতে বিশুদ্ধতম কিতাব বুখারী শরীফের মত এটিও ৩০পারায় বিন্যস্ত। স্বয়ং রচয়িতা তাঁর প্রধান খলিফাকে পত্র দ্বারা তেমনই ইঙ্গিত করেন। এ প্রসঙ্গে আল্লামা সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, “এ মহান মনীষী তাঁর বিশাল রচনা সম্ভার জীবদ্দশাতেই রচনা করে গোপন রাখেন। পরে ওফাতের সময় ঘনিয়ে এলে আমাকে পত্র মারফতে জানান ‘মাজমু‘আতে সালাওয়াতে রাসূল’ রচিত হয়েছে, যা সহীহ বুখারী শরীফের মত ৩০ পারা সম্বলিত, প্রতিটি পারা কোরআন শরীফের পারা থেকে কিছু বড়।”
দুরূদ উপজীব্য:
শুধু প্রিয়নবীর উপর দরূদ শরীফের উপর রচিত এত বৃহদাকার গ্রন্থ সম্ভবত আর রচিত হয়নি। আল্লাহ্ তা‘আলা নিজ ফেরেশতাদের নিয়ে নবীর জন্য যে বিশেষ অনুগ্রহের ধারা প্রবাহিত করেছেন এবং ঈমানদারকে যে কাজের নির্দেশ দিয়েছেন তা হল দরূদ শরীফ পাঠ করা। আর খাজা চৌর্হভী রহমাতুল্লাহি আলাইহি তার বিশাল গ্রন্থের বিষয়বস্তু হিসেবে সে কাজটিই উপজীব্য করেছেন। এ কারণে সাল্ফ-ই সালিহীনদের মধ্যে তাঁর স্বকীয়তা ও বৈশিষ্ট্য অনন্য হয়ে দেখা দিয়েছে।
ভাষাগত বৈশিষ্ট্য: প্রিয়নবীর প্রিয়ভাষা আরবী বলেই নবীর এ অতুলনীয় আশেক খাজা চৌর্হভী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি নিজে অনারবী হয়েও এ কিতাবের ভাষা বেছে নিয়েছেন আরবী। তাও রীতিমত উচ্চাঙ্গের সাহিত্যমান নিয়ে রচিত। একজন অনারব আরবী ভাষায় এতটা পারঙ্গমতা প্রদর্শন করেছেন যে, তাতে আক্বল তথা বুদ্ধি-বিবেক খেই হারাতে হয় বৈকি।
ভাব ও ভাষার চমৎকারিত্ব:
এ কিতাবে সন্নিবেশিত দরূদসমূহে প্রার্থনার আঙ্গিকে একদিক থেকে রাব্বুল আলামীনকে সম্বোধন করা হয়েছে, সাথে রাহমাতুল্লিল আলামীন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র প্রশংসা-স্তুতিও রচিত হয়েছে। সর্বোপরি একজন মুমিন আশেকের প্রয়োজনীয় হাজাত ও প্রার্থনা প্রকাশ পেয়েছে। শুধু তাই নয়, দরূদ পরিবেশনার আদলে নবীজীর বাহ্যিক ও আত্মিক সৌন্দর্যের যে অনুপম বর্ণনা এখানে উপস্থাপিত হয়েছে, এতে বোদ্ধা শ্রেণীর মরমী পাঠকের কল্পলোকে প্রিয়নবীর অস্তিত্ব অনুভব করাও বিচিত্র নয়।
আল্লামা ইসমতুল্লাহ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি এ মহান কিতাবের ভূমিকায় উল্লেখ করেন- “এ কিতাবের তাওহীদী তত্ত্বজ্ঞানসমূহ এবং প্রেমশক্তি এত দুর্নিবার ও উচ্চ যে, তা নিগূঢ় রহস্যময় ও প্রকৃত গোপন সত্ত্বা মহান আল্লাহর প্রতি পাঠককে একান্ত মোহাবিষ্ট করে দেয়। … এটা পাঠকের জন্য প্রিয় রাসূলের ভাবনা, তাঁর নূরগত, প্রকাশগত, জ্ঞানগত, কার্যগত, চরিত্রগত এককথায় সর্ববিষয়ে জ্ঞান দান করে।”
যে কিতাবে সব বিষয়ের সন্ধান ও উদাহরণ মিলে হাদীস বিশেষজ্ঞরা তা ‘জামে’ বলে মন্তব্য করেন। যে অর্থে বুখারী শরীফ ‘জামে’ কিতাব। মাজমু‘আয়ে সালাওয়াতে রাসূল কিতাবটি প্রিয়নবীর এক অভিনব জীবনচরিত এবং সর্ববিষয়ের আধার বললে যে অত্যুক্তি হবে না, গবেষকমহল তা গবেষণার মাধ্যমে যাচাই করতে পারেন। এ প্রসঙ্গে কিতাবের উর্দূ অনুবাদক আল্লামা আশরাফ সিয়ালভীর মন্তব্য
প্রণিধানযোগ্য :
“সম্মানিত রচয়িতা এখানে শুধু দরূদ শরীফ একত্রিত করাকে যথেষ্ট মনে করেন নি, বরং সায়্যিদুল আলম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সৃষ্টির প্রথম হওয়া, নূরানী সত্ত্বা হওয়ার প্রমাণ অভিনব পন্থায় বর্ণনা করেছেন। তাঁর পবিত্র জন্মের হৃদয়গ্রাহী অবস্থাদি, সর্বোত্তম স্বভাব-চরিত্র, মানবীয় সুকুমার বৃত্তির গুণসমূহের পূর্ণপ্রকাশ, তাঁর মি‘রাজসহ অলৌকিক বিষয়াদি এবং অপরাপর উচ্চতম মহত্ত্ব ও মর্যাদার বর্ণনা দ্বারাও সৌন্দর্যমণ্ডিত করে এটাকে ‘সীরাত’ ও খাসায়েস গ্রন্থের সঙ্কলনে পরিণত করেছেন। শরঈ বিধানসম্বলিত প্রিয়নবীর বাণীসমূহ এতে অন্তর্ভুক্ত করে এটাকে ফিক্ব্হ শাস্ত্রের সারাংশে রূপ দিয়েছেন। ‘তাসাওফধর্মী বর্ণনায় সমৃদ্ধ করে তাসাওফের অমূল্য দলীলের মর্যাদায়ও এটাকে উন্নীত করেছেন। আরবী সাহিত্যের উচ্চাঙ্গ রীতিতে কঠিন-জটিল বাক্য বিন্যাস, উপমা-উৎপ্রেক্ষা ইত্যাদি দ্বারা এটাকে উন্নত আরবী সাহিত্যের বিরল উদাহরণে পরিণত করেছেন। … নিঃসন্দেহে এ গ্রন্থ হাজারো দরূদ-সালামের যেমন ভাণ্ডার, তেমনি আক্বিদা আমল ও চরিত্র সংশোধন ও পরিশুদ্ধির জন্য সরল-সঠিক পথপ্রাপ্তিরও সহায়ক।”খণ্ড বিভাজন ও শিরোনাম:
ভাষাগত বৈচিত্রের কথা আপাতত বাদ দিলেও এর খণ্ড বিভাজনে যে শিরোনাম রাখা হয়েছে, সেই ত্রিশটি শিরোনামে অন্তত ত্রিশজন বিদগ্ধ গবেষক নিদেনপক্ষে ত্রিশটি গবেষণার বিষয়তো পাবেন। যেমন: প্রিয় নবীর ১. নূর ও তাঁর প্রকাশ, ২. তাঁর নূরানী সত্ত্বা ও বরকতময় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গসমূহ, ৪. তাঁর পোশাক-পরিচ্ছদের বৈশিষ্ট্য, ৫. তাঁর হাসাব-নসব তথা পূর্বপুরুষ, বংশপরম্পরা, ৬. তাঁর মান-মর্যাদা ও আভিজাত্য, ৭.তাঁর যাতী ও সেফাতী নামসমূহ, ৮.তাঁর নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব, ৯. তাঁর প্রশংসা ও মহিমা গান, ১০. তাঁর মি‘রাজ ও ঊর্ধ্বলোক ভ্রমণ, ১১. তাঁর তাসবীহ ও তাহলীল, ১২. তাঁর ধৈর্য ও সংযম, ১৩. তাঁর দু‘আ ও প্রার্থনা, ১৪. তাঁর বাণী ও বচন, ১৫. তাঁর নুবুয়ত ও রিসালাত, ১৬. তাঁর মহত্ত্ব ও সম্মান, ১৭. তাঁর সুপারিশ এবং স্রষ্টা ও সৃষ্টির যোগসূত্রতা, ১৮. তাঁর অবস্থান ও অবস্থানগত প্রভাব, ১৯. তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণাদি ও সুসংবাদসমূহ, ২০. তাঁর প্রেম ও প্রেমাষ্পদ, ২১. তাঁর প্রজ্ঞা ও অদৃশ্যজ্ঞান, ২২. তাঁর মু‘জিযা ও অলৌকিকত্ব, ২৩. তাঁর দাওয়াত ও আহ্বান, ২৪. তাঁর আদেশ-নিষেধ, ২৫. শুহুদ ও মাশহূদ (গুপ্তে-ব্যক্তে তাঁর উপস্থিতি), ২৬. তাঁর অনুপম চরিত্র, ২৭. তাঁর নৈকট্য ও আপনজন, ২৮. তাঁর সম্পৃক্ততা ও সাহচর্য, ২৯. তাঁর লিওয়ায়ে হাম্দ ও মকামে মাহমূদ, ৩০. সৃষ্টিতে তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব ও তাঁর উম্মতের শ্রেষ্ঠত্ব।
বিপন্ন মানবতায় রহমতের উসিলা:
দরূদ শরীফ নিঃসন্দেহে এমন অনন্য নিয়ামত, যা সর্বরোগের মহৌষধ ও সব সমস্যার ঐশী সমাধান। এ কিতাব তাই বিপন্ন মানুষের জন্য আল্লাহর রহমত লাভের এক অপার্থিব উসিলা তথা মাধ্যম। বিপদ-আপদ, মহামারি, ব্যবসায় অবনতি, জাহাজডুবি, জটিল-কঠিন রোগে আক্রান্ত হওয়াসহ জাগতিক জীবনে সমস্যার ফিরিস্তি শেষ হওয়ার নয়। কোরআন শরীফ ও বুখারী শরীফের মত ৩০ পারায় এ কিতাব রচনার পেছনে একটা বিশেষত্ব এও যে, এ কিতাবের খতম আদায়ের মাধ্যমে বিপন্ন মানবতার সহায়ক হিসেবে আল্লাহর রহমত প্রাপ্তিতে এই খতমে সালাওয়াতুর রাসূল পরশপাথরের মতই অব্যর্থ নেয়ামত ও মহান উসিলা। এ জন্যই ঘরে ঘরে এর তিলাওয়াতের পাশাপাশি এর খতম আদায়ের প্রচলন পরিলক্ষিত হয় ব্যাপকভাবে।
অলৌকিকত্ব:
জাগতিক শক্তি দ্বারা যে সব সমস্যার সমাধান সম্ভব হয়না, তা এ দরূদ শরীফের খতমের মাধ্যমে আল্লাহর মহান অনুগ্রহে অনায়াসে অচিন্তনীয়ভাবে সমাধান হয়ে যাওয়া এ কিতাবের বড় অলৌকিকত্ব। তবে সবচে’ বড় আশ্চর্যের বিষয়, যা এ কিতাবের প্রধান বিশেষত্বঃ তা হল স্বয়ং রচয়িতা, প্রাতিষ্ঠানিক কোন বিদ্যা শিক্ষা ছাড়া, যিনি মক্তবেও এক দিনের বেশী যাতায়াত করেননি, তাঁর হাতে এমন অতুলনীয় গ্রন্থ রচিত হওয়ার চেয়ে অলৌকিকত্ব আর কী হতে পারে। এ যেন উম্মী নবীর ‘মা কা-না ওয়ামা- য়াকূনু’ এর গায়েবী ইলমের দরিয়া হতে ডুব দিয়ে আনা এক অপার্থিব জ্ঞানের অপার রহস্যের ভাণ্ডার। আধ্যাত্মিক উৎকর্ষ সাধনের জন্য এ কিতাবের নিয়মিত তিলাওয়াতকে ওয়াজিফা হিসেবে গ্রহণ করা অতীব ফলদায়ক। তাছাড়া নিয়মিত তিলাওয়াতের মাধ্যমে নিজে খতম আদায় করতে পারলে তার হজ্বে বায়তুল্লাহ্ ও নবীর যিয়ারত লাভের সৌভাগ্য অর্জিত হয়। এমন বাস্তব দৃষ্টান্ত অনেক পীরভাইয়ের জীবনে দেখা গেছে।