Table of Contents
ভূমি ক্রয়ে করণীয়, দলিল তল্লাশি করার পদ্ধতি ও ভূমির কাগজপত্র যাচাই
ভূমি ক্রয়ে করণীয়
খেটে খাওয়া মানুষেরা সারা জীবনের কষ্টার্জিত জমানো টাকা দিয়ে জমি ক্রয় করে থাকে। বর্তমানে সে মানুষেরা জায়গা জমি ক্রয়ে অত্যধিক জালিয়াতির শিকার হয়ে নিজের সারা জীবনের ঘামঝরানো টাকা পয়সা হারিয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছে। তাই জায়গা-জমি ক্রয়ে অধিক সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। তাই যে কোনো জমি ক্রয়ের পূর্বে বিক্রেতার কাছ থেকে উক্ত জমির দলিলসমূহের ফটোকপি সংগ্রহ করে নিতে হবে। তারপর সেগুলোকে খুব ভালোকরে যাচাই- বাছাই করতে হবে। সম্ভব হলে একজন দেওয়ানী বিশেষজ্ঞ আইনজীবী (Civil Lawer) এর সহযোগিতা নেওয়া যেতে পারে। একটি ভূমির কাগজপত্র (Document) এর পরিশুদ্ধতা নির্ণয় করার পদ্ধতি নিম্নে ধারাবহিকভাবে আলোচনা করা হল।
জেনে রাখা ভালো যে, ভূমির মালিকানা সাধারণত ৩ ভাবে অর্জন হয়ঃ- (ক) ওয়ারিশানসূত্রে (খ) ক্রয়সূত্রে (গ) আদালতের হুকুমে। এছাড়া আর যা হবে তা হবে ভুলসূত্রে।
সুতরাং প্রাথমিকভাবে বিক্রেতার কাছ থেকে যে সমস্ত কাগজপত্রের ফটোকপি নিতে হবে-
- বর্তমান বিক্রেতা ক্রয়সূত্রে মালিক হলে তার ক্রয় দলিল।
- প্রস্তাবিত সম্পত্তি বিক্রেতার পূর্বে সর্বশেষ চূড়ান্ত জরীপের পর থেকে যতবার হস্তান্তর হয়েছে তার সকল ভায়া দলিল।
- কৃত জরীপসমূহের খতিয়ান বা পর্চা (Record of Rights) সি.এস, আর.এস, এস.এ বা পি.এস, এবং বি.এস. খতিয়ান।
- খাজনার রশিদ।
- ডি.সি.আর বা ডুপ্লিকেট কার্বন রশিদ।
- শহরের বাসা-বাড়ী বা ভবন হলে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, পৌরকর বিক্রেতার নিজ নামে পরিশোধিত হয়ে আসছে কিনা।
- অন্যান্য ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট যে কোনো দলিল, ডিক্রি, ডকুমেন্ট ইত্যাদি।
- ভবন বা বিল্ডিং বা ফ্ল্যাট ক্রয়ের ক্ষেত্রে সংশিষ্ট দপ্তর থেকে নেয়া অনুমোদিত নকশা দেখতে হবে এবং নকশা অনুযায়ী ভবন তৈরী হয়েছে কি না তা দেখে নিতে হবে।
দলিল তল্লাশি করার পদ্ধতি
যে দলিল তল্লাশি করবেন তার দলিল নং সম্পাদনের তারিখ, দলিলের দাতা- গ্রহীতার নাম এবং মৌজার নাম, যে অফিসে রেজিস্ট্রি হয়েছে সে অফিসের নাম জানা থাকলেই চলবে। তবে দলিলের ফটোকপি থাকলে সাথে ফটোকপি দিতে পারলে আরো ভালো। একটি দলিলের তল্লাশি রেজিস্ট্রি অফিসে দুইভাবে করা যায়:
- সংশ্লিষ্ট রেজিস্ট্রি অফিসের রেকর্ড রুমের বা জেলা পর্যায়ে ডিসির মুহাফেজ খানার ক্লার্কের মাধ্যমে দলিলের বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে ভলিয়ম বই দেখে জেনে নেয়া যায়।
- বিধি মোতাবেক যথারীতি তল্লাশি ফী প্রদানপূর্বক আবেদনের মাধ্যমে এ বিষয়ে জেনে নেয়া যায়। প্রয়োজনবোধে সংশ্লিষ্ট রেজিস্ট্রি অফিস থেকে NEC (Non Encumbrance Certificate) গ্রহণ করা যায়। যাতে উক্ত জমির সর্বশেষ মালিকের নাম থাকবে। এ সব তল্লাশি সংশ্লিষ্ট অফিসের ক্লার্কের মাধ্যমে করা যায়। ইচ্ছানুযায়ী যে কোনো বৎসরের তল্লাশি করা যায়। তবে স্থাবর সম্পত্তি ন্যূনতম বিগত ২৫ বৎসরের তল্লাশি করা ভালো।
তল্লাশির মাধ্যমে দলিলের যে বিষয়গুলো জানা যাবে
- সঠিক নিয়মে দলিলটি উক্ত অফিসে রেজিস্ট্রি হয়েছে কি না?
- উক্ত রেজিস্ট্রিভুক্ত দলিলের সম্পত্তি ইতঃপূর্বে অন্য কারো কাছে বিক্রি কিংবা কোনোভাবে কোথাও দায়বদ্ধ করা হয়েছে কি না?
- এই জমি অন্য কোনো জমির সাথে এওয়াজ-বদল করা হয়েছে কি না?
- কোনো ব্যাংক বা প্রতিষ্ঠানে কিংবা কোনো ব্যক্তিকে উক্ত সম্পত্তি বন্ধক দেওয়া আছে কি না?
- ইতঃপূর্বে কাউকে বর্ণিত সম্পত্তির আমমোক্তার (power of Attorney) দেয়া হয়েছে কি না?
- উক্ত দলিলের মোট সম্পত্তির কোনো অংশ বা পরিমাণ বিক্রি হয়েছে কি না এবং সর্বশেষ এ দলিলে কী পরিমাণ সম্পত্তি বহাল আছে? ইত্যাদি।
ভূমির কাগজপত্র (Document) যাচাইকালে নিম্নোক্ত বিষয়সমূহ সতর্কতার সাথে বিবেচনায় রাখতে হবে:
- ওয়ারিশসূত্রে মালিক হলেঃ
পূর্ব পুরুষের মালিকানায় ধারবাহিকতা পরীক্ষা করতে হবে এবং বর্তমান ওয়ারিশ বিক্রেতার ফারায়েজনামা সঠিক আছে কি না তা যাচাই করতে হবে। এক্ষেত্রে খতিয়ে দেখতে হবে যে, কোনো ওয়ারিশান/উত্তরাধীকারীকে উক্ত ফারায়েজনামায় অনুপস্থিত রাখা হয়েছে কি না। প্রয়োজনবোধে জমি রেজিস্ট্রির পূর্বে আইনানুগভাবে সকল অংশীদারকে নোটিশ দেয়া বা বিজ্ঞপ্তি জারি করতে হবে। যেন শোফা বা Pre-emption (প্রী-এশন) অগ্র ক্রয়াধিকার এর মাধ্যমে আপনার ক্রয়কৃত সম্পত্তি নিয়ে যেতে না পারে। (শোফা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে ফিরে কিতাব বিশেষকরে হেদায়া ৪র্থ খণ্ড দ্রষ্টব্য) ওয়ারিশান বা এজমালি সম্পত্তি কোনো একজন অংশীদার থেকে ক্রয় করলে অন্য অংশীদারগণকে সাফ কবলা দলিলে সাক্ষী রাখা জরুরী। তবে কারো কাছ থেকে তার ফারায়েজকৃত প্রাপ্য অংশের চেয়ে বেশি সম্পত্তি ক্রয় করা যাবে না।
- দানসূত্রে মালিক হলে:
দানপত্রসহ অপরাপর বর্ণিত প্রয়োজনীয় সকল বিষয় পরীক্ষা করে মালিকানার সত্যতা নিশ্চিত করতে হবে।
- জরীপি রেকর্ডসূত্রে মালিক হলেঃ
অন্যান্য বিষয়াদি পরীক্ষার পাশাপাশি রেকর্ডীয় হাল পর্চা বা খতিয়ানও যাচাই করতে হবে।
- আদালতের ডিক্রিমূলে মালিক হলে:
প্রথমে আদালতের ডিক্রিনামা (বিক্রয় চুক্তিনামা) তারপর অপরাপর পদ্ধতিতে অন্যান্য প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে।
- নিলাম খরিদসূত্রে মালিক হলে:
নিলাম খরিদ সংশ্লিষ্ট সকল কাগজপত্রসহ নিলাম খরিদসূত্রে দখল প্রাপ্ত হয়েছে কি না? রেকর্ডপত্র যাচাই করে দেখতে হবে।
- মালিকানার রেকর্ড পরীক্ষা:
বিক্রেতার মালিকানার রেকর্ড পরীক্ষা করতে হবে। অর্থাৎ, সি.এস, এস.এ, আর.এস ও বি.এস রেকর্ডীয় খতিয়ান, নামজারী খতিয়ান ইত্যাদি ভালোকরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে মালিকানার ব্যাপারে নিশ্চিত হতে হবে। খতিয়ানের নম্বর পুরোপুরি মিল আছে কি না তা দেখে নিতে হবে।
- দখল পরীক্ষা:
বিক্রেতা প্রস্তাবিত সম্পত্তির দখলে আছেন কি না তা যাচাই করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ। কারণ মালিকানার সমস্ত দালীলিক প্রমাণ একদিকে আর দখলই আরেক দিকে। মানুষ কথায় বলে 'সাতটি ডিক্রি (কোর্টের রায়) আর একটি দখল' দলিল এবং দখল দু'টির সমন্বয়ে পূর্ণ মালিকানা অর্জন হয়। সম্পদের দখল না থাকলে অন্য সব দলিল প্রমাণ ঠিক থাকলেও তা নিজ দখলে আনা খুব কঠিন ব্যাপার। আর যদি লোকটি নিরীহ হয় তবে তো বলার অপেক্ষাই রাখে না। তাই সম্পত্তি ক্রয়ের পূর্বেই ভালোকরে দেখে নিতে হবে যে, সম্পত্তি ক্রয়ের পরে দখল পেতে কোনো সমস্যা হবে কি না? এক্ষেত্রে প্রয়োজনে বিক্রেতার সাথে কথা বলে ক্রয়ের কিছুদিন পূর্ব হতে প্রস্তাবিত ভূমিতে একটি ক্রয় বা বায়নানামার সাইনবোর্ড দিয়ে রাখা যায়।
- খাজনা পরিশোধের রশিদ, ডি.সি.আর:
বিক্রেতার নিজ নামে খাজনা পরিশোধ, নামজারি করা আছে কি না এবং ডি.সি. আর (ডুপ্লিকেট কার্বন রশিদ) কাটা আছে কি না দেখে নিতে হবে।
- বিল্ডিং নকশা ও রাজউকের অনুমোদনপত্র:
শহর এলাকার বিল্ডিং বা ভবন ক্রয়ের পূর্বে সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষের অনুমোদিত নকশা এবং রাজউকের অনুমোদনপত্র যাচাই করে নিতে হবে। আননোমোদিত নকশা দ্বারা কিংবা অনুমোদিত নকশার নির্দেশনার বাইরে নির্মাণকৃত যে কোনো ভবন কিংবা ফ্ল্যাট ইত্যাদি ক্রয় করা যাবে না।
- সম্পত্তির উপর ঋতঃ
সম্পত্তি কোথাও বন্ধক, সম্পত্তির উপর কোনো প্রকার ঋত কিংবা কোনো বিল, ট্যাক্স বকেয়া আছে কি না?
- মামলা মোকাদ্দমাঃ
প্রস্তাবিত সম্পত্তির উপর দেওয়ানী, সেটেলম্যান্ট, রাজস্ব ইত্যাদি আদালতে বর্তমানে কোনো প্রকার মামলা আছে কি না বা অতীতে কখনো ছিল কি না?
- বায়নানামাপত্র দ্বারা আবদ্ধ:
উক্ত সম্পত্তি কারো সাথে বিক্রয় চুক্তিতে আবদ্ধ আছে কি না
- আইন আবদ্ধ:
সম্পত্তিটি সরকারি খাস, পরিত্যক্ত, শত্রু বা অর্পিত সম্পত্তি কি না
- অধিগ্রহণ:
প্রস্তাবিত সম্পত্তিতে কখনো ভূমি অধিগ্রহণের প্রস্তাব ছিল কি না অধিগ্রহণ সম্ভাবনাময় ভূমি ক্রয়ের ক্ষেত্রে সম্পত্তিটি অধিগ্রহণকৃত কি না তা খতিয়ে দেখতে হবে।
- সম্পত্তি ক্রয়ে ক্ষেত্রবিশেষ আরো যা লক্ষণীয়:
কোনো বিধিবদ্ধ সংস্থা বা সমিতির মালিকানা সম্পত্তি ক্রয়ে বিশেষভাবে সাবধানতা অবলম্বন ও যাচাই-বাছাই করে সম্পত্তি ক্রয় করতে হবে। আমমোক্তার দলিল দ্বারা বিক্রয়কৃত সম্পত্তি ক্রয়ের সময় আমমোক্তারনামা ভালোকরে পরীক্ষা করে নেওয়া বাঞ্চনীয়।
পরিবেশ সংরক্ষণ বিষয়ে জমির উপর কোনো প্রকার বিধি-নিষেধ আছে কি না, প্রস্তাবিত সম্পত্তি আশেপাশের জনগণের দেওয়া তথ্য মোতাবেক কাগজপত্রের তথ্যের ভিত্তিতে মালিকানায় মিল আছে কি না, বিক্রেতা নাবালক কিংবা অপ্রকৃতস্থ কি না লক্ষ রাখতে হবে। নাবালকের সম্পত্তি ক্রয় করতে হলে আদালতের মাধ্যমে অভিভাবক নিযুক্ত করে বিক্রয় অনুমতি নিয়ে তবেই ক্রয় করতে হবে। হিন্দু সম্প্রদায়ের কোনো মহিলার কাছ থেকে জমি ক্রয়ের পূর্বে অবশ্যই জেনে নিতে হবে উক্ত সম্পত্তি তার পূর্ণ মালিকানায় না কি জীবনস্বত্ত্বে শুধু ভোগের মালিক? কারণ জীবনস্বত্ত্বে প্রাপ্ত সম্পত্তি তারা বিক্রয় করতে পারে না। - যাতায়াতের রাস্তা:
জমিটির যথাযথ রাস্তা আছে কি না, বা পরবর্তীতে রাস্তা করে নেয়া যাবে কি না, বা বর্তমানে বিদ্যমান রাস্তা নিয়ে প্রতিবেশীর সাথে কোনো বিরোধ আছে কি না, কিংবা এজমালি রাস্তা ব্যবহারে পরবর্তীতে অসুবিধা হবে কি না অর্থাৎ, নির্ভেজাল রাস্তার সুবিধা আছে কি না।
সর্বোপরি প্রতিবেশী ভালো আছে কি না, এবং বাসা-বাড়ীর ক্ষেত্রে বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, আশ-পাশে ভালো কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ-মাদরাসা আছে কি না, এসব খুব ভেবে চিন্তে, দেখে-শুনেই বাড়ী ক্রয় করা দরকার।