Table of Contents
ফাজিল ইসলামী অর্থনীতি ১ম পত্র: ইসলামী অর্থনীতির মৌলিক বিষয়
বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে অর্থনীতির সংজ্ঞা দাও। আধুনিক সমাজে অর্থনীতি পাঠের গুরুত্ব আলোচনা কর অথবা, বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে অর্থনীতির সংজ্ঞা দাও। অর্থনীতি পাঠের গুরুত্ব বর্ণনা কর। অথবা, অর্থনীতি বলতে কী বুঝায়? আধুনিক সমাজে অর্থনীতি পাঠের প্রয়োজনীয়তা আলোচনা কর।
ভূমিকা:
অর্থনীতি এমন একটি বিজ্ঞান যা মানবজীবনের সমুদয় অর্থনৈতিক কার্যাবলির বিশ্লেষণ, নিয়ন্ত্রণ ও সমন্বয় সাধন করে থাকে। বর্তমান সময়ে অর্থনীতি একটি অপরিহার্য ও অত্যাবশ্যকীয় বিষয়। মানবজীবনের যেকোনো সমস্যা অর্থনীতির সাথে কোনো না কোনোভাবে সম্পর্কযুক্ত। মানুষ তার সীমিত সম্পদ দ্বারা কিভাবে সীমাহীন অভাব পূরণ করতে পারে, অর্থনীতি সে বিষয়ে দিক-নির্দেশনা দিয়ে থাকে। তাই অর্থনীতির সাথে আমাদের সামগ্রিক জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক বিরাজমান।
অর্থনীতির সংজ্ঞা:
ক. অর্থনীতির সম্পদ ভিত্তিক সংজ্ঞা: অর্থনীতির জনক ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ এডাম স্মিথ (Adam Smith) ১৭৭৬ খ্রিষ্টাব্দে তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘An Enquiry into the Nature and Causes of the Wealth of Nations’- এ অর্থনীতির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, “অর্থনীতি হচ্ছে এমন একটি বিজ্ঞান যা জাতিসমূহের সম্পদের প্রকৃতি এবং কারণ সম্পর্কে অনুসন্ধান করে।” অর্থাৎ তিনি অর্থনীতিকে ‘সম্পদ বিজ্ঞান’ হিসেবে অভিহিত করেন।
খ. অর্থনীতির কল্যাণভিত্তিক সংজ্ঞা: অর্থনীতির কল্যাণভিত্তিক সংজ্ঞার উদ্ভাবক পিগু (pigou) হলেও অধ্যাপক মার্শালের সংজ্ঞাটি কল্যাণের ক্ষেত্রে বেশি গ্রহণযোগ্য। তিনি বলেন, “অর্থনীতি মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সাধারণ কার্যাবলি আলোচনা করে।” এটি একদিকে ধনবিজ্ঞান, অন্যদিকে মানববিজ্ঞান। এখানে সাধারণ কার্যাবলি বলতে অর্থ আয় ও ব্যয় সম্পর্কিত কার্যাবলিকে বুঝায়।
গ. অর্থনীতির অপ্রতুলতা, পছন্দ ও ব্যয় সংকোচনমূলক সংজ্ঞা: এ ধরনের সংজ্ঞার অন্যতম উদ্ভাবক হলেন অধ্যাপক এল. রবিন্স (L. Robins)। তিনি অর্থনীতির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, “অর্থনীতি এমন একটি বিজ্ঞান যা সীমাবদ্ধ সম্পদের বিকল্প ব্যবহার এবং অসীম অভাবের মধ্যে সম্পর্ক বিষয়ক মানব আচরণ বিশ্লেষণ করে।"এ সংজ্ঞা থেকে তিনটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে- ১. মানুষের অভাব অসীম। ২. সম্পদের যোগান সীমিত। ৩. সম্পদের বিকল্প ব্যবহার সম্ভব।
সুতরাং তাঁর সংজ্ঞায় অর্থনীতির বিষয়বস্তুর প্রায় পুরোটাই এসে পড়ে। তবে তিনি অর্থনীতির নীতিগত দিক বিবেচনা করেন নি।
অর্থনীতিক চিন্তার জগতে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে লর্ড জে. এন. কেইনস (J. N. Keynes)। তাঁর মতে, “অর্থনীতি হলো সীমাবদ্ধ সম্পদ এবং আয় ও নিয়োগ নির্ধারণকারী বিষয়সমূহের প্রশাসনিক পর্যালোচনা।” তিনি আরো বলেন, “সমাজের আয় ও নিয়োগ কিভাবে নির্ধারিত হয় তা পর্যালোচনা করাই অর্থনীতির কাজ।” পরিশেষে বলা যায় যে, আধুনিককালে অর্থনীতিতে ব্যক্তি ও সমাজ উভয়ের অর্থনৈতিক কার্যাবলি স্থান পেলেও ব্যক্তি অপেক্ষা সমাজের কার্যাবলিই প্রাধান্য পেয়েছে বেশি।
আধুনিক সমাজে অর্থনীতি পাঠের গুরুত্ব:
অর্থনীতিকে যখন ‘সম্পদের বিজ্ঞান’ বলে অভিহিত করা হতো তখন এর পরিধি ছিল সংকীর্ণ। বর্তমানে অর্থনীতির পরিধি ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হওয়ায় একে বর্তমান যুগের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক বিজ্ঞান বললেও অত্যুক্তি হবে না। আধুনিক সমাজে অর্থনীতি পাঠের গুরুত্ব নিম্নে আলোচনা করা হলো-
১. দৈনন্দিন জীবনে গুরুত্ব: সমাজে সকল স্তরের মানুষের দৈনন্দিন জীবন এক অদৃশ্য অর্থনৈতিক কার্যাবলির ঐক্যসূত্রে গ্রথিত। বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে অর্থনৈতিক কার্যাবলির গণ্ডি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিস্তৃত হয়েছে। তাছাড়া
অর্থনৈতিক কার্যাবলির বিভিন্ন সমস্যা মানুষের প্রাত্যহিক জীবনকে প্রভাবিত করে। তাই অর্থনীতি পাঠের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।
২. সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার: অভাব পূরণের জন্যে কিভাবে সম্পদ বৃদ্ধি করা যায় এবং কিভাবে সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা যায় তা অর্থনীতির জ্ঞান থেকে জানা যায়। বস্তুত মানবজীবনের অর্থনৈতিক কল্যাণ বৃদ্ধি করাই অর্থনীতির মূল লক্ষ্য। মানুষের অভাব অসীম কিন্তু সম্পদ সীমাবদ্ধ, তাই এ সীমিত সম্পদের সর্বাধিক সুষ্ঠু ব্যবহার দ্বারা অভাব পূরণ করার নির্দেশনা দেয়া অর্থনীতির মূল কাজ। এ দৃষ্টিকোণ থেকে সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারের কৌশল জানতে অর্থনীতি পাঠের গুরুত্ব অপরিসীম।
৩. ব্যবসায়-বাণিজ্য ও উৎপাদন: বর্তমান মুক্ত বাজার অর্থনীতির যুগে এর পরিধি দিন দিন সম্প্রসারিত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ফলে বহুমুখী ব্যবসা-বাণিজ্য চালু হয়েছে। ফলে পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধির জন্যে উৎপাদন কৌশল পরিবর্তন ও উৎপাদনের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে করে উৎপাদন ও বাজারজাতকরণেও নতুন নতুন সমস্যা দেখা দিচ্ছে। ব্যবসা-বাণিজ্য ও উৎপাদনের ক্ষেত্রে যেসব জটিল সমস্যা দেখা দেয় সেগুলো অর্থনীতির বিভিন্ন তত্ত্বের আলোকে সমাধান করা যায়। তাই আধুনিককালে ব্যবসায়ী ও উৎপাদনকারীরা অর্থনীতির তাত্ত্বিক জ্ঞানের ভিত্তিতে তাদের সমস্যার সমাধান করেন।
৪. সমাজকর্মীদের কাজে: যেকোনো দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো একে অপরের সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। অর্থনৈতিক চলকগুলো সমাজের মানুষের কল্যাণের লক্ষ্যেই গড়ে ওঠেছে, যাতে মানুষ সর্বাধিক কল্যাণ অর্জন করতে পারে। সামাজিক বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করে বলে অর্থনীতিকে ‘সামাজিক বিজ্ঞান’ (Social Science) বলা হয়। তাই সমাজকর্মীদের অর্থনীতি সম্পর্কে জ্ঞান থাকা আবশ্যক। দারিদ্র্যতা, বেকারত্ব, ভিক্ষাবৃত্তি, খাদ্যাভাব ইত্যাদি সামাজিক সমস্যাগুলো সমাধানের সুষ্ঠু পথ নির্দেশ প্রদান করতে হলে সমাজকর্মীদের অর্থনীতি সম্পর্কে জ্ঞান থাকা একান্ত জরুরি।
৫. শ্রমিক নেতাদের ক্ষেত্রে: শ্রম উৎপাদনের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বিধায় অর্থনীতিতে শ্রমের মজুরি ও শ্রমনীতি সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। শিল্পের বিকাশ ও শিল্পোন্নয়নের যুগে শ্রমিকগোষ্ঠী অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শ্রমিক সংঘ গঠন ও শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি-দাওয়া আদায়ে শ্রমিক নেতাদের অবশ্যই অর্থনীতি সম্পর্কে জ্ঞান থাকা প্রয়োজন।
৬. সরকারি প্রশাসনে: অর্থনৈতিক তত্ত্বের জ্ঞান ছাড়া সরকারি অর্থনৈতিক কার্যকলাপ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা যায় না। সকল দেশের সরকারকে তার আয়- ব্যয়ের বাজেট করতে হয় এবং বিভিন্ন সময়ে ঋণগ্রহণ ও পরিশোধ করতে হয়। অনেক সময় সরকারকে রাষ্ট্রীয় আয়-ব্যয় হ্রাস-বৃদ্ধি করতে এবং বিভিন্ন দ্রব্য উৎপাদন ও ভোগের ক্ষেত্রে বিভিন্ন বিধি-নিষেধ আরোপ করতে হয়। এসব কার্য সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের জন্যে প্রশাসককে অর্থনীতি সম্পর্কে সচেতন থাকতে হয়। তাই সরকারি প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডে অর্থনীতির জ্ঞান একান্ত অপরিহার্য।
৭. পরিকল্পনা প্রণয়ন ও রূপায়ণে: পরিকল্পনার মূলকথা হলো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য সাধনের উদ্দেশ্যে দেশের সীমিত সম্পদের পূর্ণতম ব্যবহার নিশ্চিত করা। এ লক্ষ্য সাধনের জন্যে দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক কার্যাবলির বর্তমান অবস্থা ও অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকা আবশ্যক। এর সাথে সাথে প্রয়োজন অর্থনৈতিক তত্ত্ব সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞান এবং সেগুলো বাস্তবে প্রয়োগের কৌশল আয়ত্ত করা। তাই পরিকল্পনা প্রণয়ন ও রূপায়ণের ক্ষেত্রে অর্থবিদ্যা অধ্যয়ন খুবই জরুরি।
৮. বিদ্যাচর্চার ক্ষেত্রে: অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান অর্থনৈতিক তত্ত্বের মধ্যেই লুকিয়ে আছে। সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিতে অর্থনীতির আলোচনা ও বিচার-বিশ্লেষণ শুধুমাত্র অর্থনৈতিক কার্যকলাপের রহস্যই উন্মোচন করে না; বরং আমাদের চিন্ত াশক্তি ও বুদ্ধিবৃত্তির উৎকর্ষ সাধন করে। এর ফলে মানুষ যুক্তিবাদী ও বস্তুনিষ্ঠ হয়ে ওঠে। আর বর্তমান যুগ হচ্ছে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সম্প্রসারণ ও গবেষণার যুগ। একদিকে মানুষ নতুন নতুন সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে আর অন্যদিকে সমস্যা সমাধানের নতুন কৌশলগুলো আবিষ্কৃত হচ্ছে। তাই যুগোপযোগী সমস্যার মোকাবিলার জন্যে অর্থনীতি পাঠের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
৯. রাজনীতিবিদদের কাছে: বহুদলীয় গণতন্ত্র ও সাংবিধানিক সরকার পদ্ধতিতে মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকে বিধায় রাজনীতিবিদরাই দেশের কর্ণধার হয়। তারা দেশের বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক সমস্যাবলি সমাধানের জন্যে সরকারের পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করে থাকে। দেশের মৌলিক অর্থনৈতিক সমস্যাবলি সম্পর্কে রাজনীতি বিদদের অবহিত থাকতেই হবে। কারণ তারাই দেশের অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারণের মূলনিয়ামক। তাই রাজনৈতিক সাফল্য অর্জনের জন্যে অর্থনীতি পাঠ করা অপরিহার্য।
১০. অনুন্নত দেশের ক্ষেত্রে: পৃথিবীর অনুন্নত দেশগুলোতে বহুবিধ অর্থনৈতিক সমস্যা থাকে। দারিদ্র্য, বেকারত্ব, মুদ্রাস্ফীতি, নিম্ন উৎপাদনশীলতা, খাদ্যাভাব, জনসংখ্যা বিস্ফোরণ ইত্যাদি সমস্যার জন্যে এসব দেশের উন্নয়নের গতি মন্থর। এসব সমস্যার বিশ্লেষণ ও তা সমাধানের জন্যে অর্থনীতির বিভিন্ন শাখার জ্ঞান অপরিহার্য। তাই অনুন্নত দেশগুলোতে অর্থনীতি পাঠের গুরুত্ব তুলনামূলকভাবে বেশি।
উপসংহার:
উপরিউক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, মানব সভ্যতা বিকাশের সাথে সাথে অর্থনীতি একটি কল্যাণমুখী সামাজিক বিজ্ঞানের মর্যাদা লাভ করেছে। ফলে এর তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক গুরুত্ব ক্রমশ বৃদ্ধি পায়। অর্থনীতি পাঠের গুরুত্ব সম্পর্কে অধ্যাপক মার্শাল বলেন, "অর্থনীতি পাঠ করা অবশ্যই প্রয়োজন। কারণ এটি অর্থনীতি সম্পর্কে জ্ঞানলাভ ছাড়াও বাস্তব জীবনের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে সহায়তা করে।"