ফতোওয়ায়ে আহলে সুন্নাহ (আটটি বিষয়ের সমাধান) | গ্রন্থনা ও সংকলনেঃ মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ বাহাদুর - Fatawaye Ahle-Sunnah (Resolution of Eight Matters) | Written and compiled by: Muhammad Shahidullah Bahadur

ফতোওয়ায়ে আহলে সুন্নাহ (আটটি বিষয়ের সমাধান) | গ্রন্থনা ও সংকলনেঃ মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ বাহাদুর - Fatawaye Ahle-Sunnah (Resolution of Eight Matters) | Wri
Join Telegram for More Books
Table of Contents
ফতোওয়ায়ে আহলে সুন্নাহ (আটটি বিষয়ের সমাধান) | গ্রন্থনা ও সংকলনেঃ মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ বাহাদুর

ফতোওয়ায়ে আহলে সুন্নাহ (আটটি বিষয়ের সমাধান)

গ্রন্থনা ও সংকলনেঃ 
মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ বাহাদুর 
প্রতিষ্ঠাতা, ইমাম আযম রিসার্চ সেন্টার, বাংলাদেশ। 

 সম্পাদনা পরিষদঃ 
আল্লামা মুফতি আলাউদ্দিন জিহাদী (মা.জি.আ.) 
মুনাজেরে আহলে সুন্নাহ ও বিশিষ্ট ইসলামী লেখক ও গবেষক।

প্রথম অধ্যায়ঃ ঈদে মিলাদুন্নবী (ﷺ) প্রসঙ্গ

শাব্দিক অর্থে জশনে জুলুসে ঈদে মীলাদুন্নবী (ﷺ) : جشن (জশন) একটি ফার্সী শব্দ যার অর্থ খুশি বা আনন্দ আর جلوس শব্দটি আরবী। তার অর্থ সম্পর্কে فيروز اللغات এর ৪৬২ নং পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে- اميروں اورباد شايوں كى سوارى كسى خاص موقع پر بھت سے لوگوں کا اکٹھے ھوکر بازاروں غيره ميں سے گزرنا - -‘‘জুলুস হলো অনেক লোক কোন খাছ বা বিশেষ সময়ে একত্রিত হয়ে আমীর ও বাদশাহদের সাওয়ারী নিয়ে বাজার ও শহরের মধ্যে দিয়ে অতিক্রম করা।’’ ঈদে মীলাদুন্নবী (ﷺ) অর্থ রাসূল (ﷺ)- এর দুনিয়ায় শুভাগমন উপলক্ষ্যে আনন্দ পালন করা। সুতরাং জশনে জুলুসে ঈদে মীলাদুন্নবী (ﷺ) অর্থ- হলো রাসূলে করিম (ﷺ) এর দুনিয়ায় আগমন বা মীলাদুন্নবী (ﷺ) উপলক্ষ্যে আনন্দ শুভাযাত্রা বের করা। প্রচলিত অর্থে জশনে জুলুসে ঈদে মীলাদুন্নবী (ﷺ) ১২ রবিউল আউয়াল তারিখে রাসূল (ﷺ) এর দুনিয়ায় শুভাগমন উপলক্ষ্যে অনেক রাসূল প্রেমিক মুসলমানগণ একত্রিত হয়ে পবিত্র ও সুন্দর পোষাক পরিচ্ছদ পরিধান করে আতর গোলাপ গায়ে মেখে কালামে পাক, নাতে রাসূল (ﷺ) এবং নবী করিম (ﷺ) এর প্রতি দরূদ ও সালাম পাঠ করে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ) এর নামে শ্লোগান দিয়ে রাস্তায় বা শহরে শুভাযাত্রা সহকারে আনন্দের সহিত নবী করিম (ﷺ) এর শুভগমন ও তৎসম্বলিত ঘটনাবলীর আলোচনার যে বিরাট মাহফিল অনুষ্ঠিত হয় তার নাম জশনে জুলুসে ঈদে মীলাদুন্নবী (ﷺ)। অতএব, এখন আমি “জশনে জুলুসে ঈদে মীলাদুন্নবী (ﷺ) উদযান করাকে হারাম, নাজায়েয ও গোনাহের কাজ ইত্যাদি ফতোয়া দানকারী আলেমদের নিকট জানতে চাই উপরে বর্ণিত আমল সমূহ বা কাজগুলো থেকে কোন্ কোন্ আমল গুনাহ ও নাজায়েয যার কারণে আপনারা পবিত্র জশনে জুলুসকে হারাম ফতোয়া দিচ্ছেন। বলতে পারবেন কি? কিয়ামত পর্যন্ত কোন উত্তর মিলবে না।

মহান আল্লাহ তা‘য়ালা নিয়ামাত প্রাপ্তির পর তার শোকরিয়া আদায়ের জন্য মহান রব কুরআনে বহুবার তাগিদ দিয়েছেন। আর আল্লাহর বড় অনুগ্রহ বা নিয়ামত হলো রাসূলুল্লাহ (ﷺ)। তাই রাসূল (ﷺ) কে পেয়ে খুশি, আনন্দ, উল্লাস উদ্যাপন করা মহান আল্লাহ তা‘য়ালার নির্দেশ। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে- قُلْ بِفَضْلِ اللَّهِ وَبِرَحْمَتِهِ فَبِذَٰلِكَ فَلْيَفْرَحُوا هُوَ خَيْرٌ مِّمَّا يَجْمَعُونَ (يونس-٥٨)… হে হাবিব! আপনি বলে দিন আল্লাহর অনুগ্রহ (ইলম) ও তার রহমত (রহমাতুল্লিল আলামিন) প্রাপ্তিতে তাদের (মু‘মিনদের) খুশি (ঈদ) উদযান করা উচিত এবং আর সেটা হবে তাদের জমাকৃত ধন সম্পদ অপেক্ষা শ্রেয়।’’ (সুরা ইউনুস-৫৮).. এ আয়াতে আল্লাহর (ফদ্বল) অনুগ্রহ এবং আল্লাহর রহমত (রহমাতাল্লিল আলামিন) পাওয়ার পরে মুমিনদের খুশি মানে ঈদ উদযাপন করার নির্দেশ মহান আল্লাহর। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বিখ্যাত তাফসিরকারক ও হাফিজুল হাদিস ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতি (رحمة الله) (ওফাত. ৯১১হি.) লিখেন- وَأخرج أَبُو الشَّيْخ عَن ابْن عَبَّاس رَضِي الله عَنْهُمَا فِي الْآيَة قَالَ: فضل الله الْعلم وَرَحمته مُحَمَّد صلى الله عَلَيْهِ وَسلم قَالَ الله تَعَالَى وَمَا أَرْسَلْنَاك إِلَّا رَحْمَة للْعَالمين. (১০৭ الْأَنْبِيَاء الْآيَة ) -‘‘ইমাম আবু শায়খ ইস্পাহানী (رحمة الله) তার তাফসীরে উল্লেখ করেন, সাহাবি হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, এখানে আল্লাহর (ফাদ্বল) বা অনুগ্রহ দ্বারা ইলম বা জ্ঞানকে এবং (রহমত) দ্বারা নবীজী (ﷺ) কে বুঝানো হয়েছে। যেমন মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন- হে হাবিব আমি আপনাকে সমগ্র বিশ্ব-জগতের জন্য রহমত স্বরূপ প্ররেণ করেছি। (সুরা আম্বিয়া, আয়াত নং-১০৭)।’’ (ইমাম তিরমিযী-মাজমাউল বায়ান,৫/১৭৭-১৭৮পৃ) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বিখ্যাত মুফাস্সির ইমাম সৈয়দ শিহাবুদ্দীন মাহমুদ আলূসী বাগদাদী (رحمة الله) (ওফাত. ১২৭০হি.) স্বীয় তাফসীরে উল্লেখ করেন- وأخرج أبو الشيخ عن ابن عباس رضي الله تعالى عنهما أن الفضل العلم والرحمة محمد صلّى الله عليه وسلم. “হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) এ আয়াতের তাফসীরে বলেন নিশ্চয়ই (ফাদ্বলুল্লাহ্) বা অনুগ্রহ হল ইলমে দ্বীন এবং রহমত হলো নবী করিম (ﷺ)।’’ (আল্লাম শিহাব উদ্দিন সৈয়দ মাহদুদ আলুসী-রুহুল মা'আনী,৬/১৩৩পৃ) ইমাম সৈয়দ মাহমুদ আলূসী (رحمة الله) আরও উল্লেখ করেন- وأخرج الخطيب، وابن عساكر عنه تفسير الفضل بالنبي عليه الصلاة والسلام. -‘‘হযরত খতিবে বাগদাদী (رحمة الله) এবং ইমাম ইবনে আসাকীর (رحمة الله) সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) হতে বর্ণনা করেন, ফাদ্বল (অনুগ্রহ) দ্বারাও নবী করীম (ﷺ) কে বুঝানো হয়েছে।” (আল্লামা শিহাব উদ্দিন মাহমুদ আলুসী-রুহুল মা'আনী,৬/১৩৩পৃ) সম্মানিত পাঠকবৃন্দ! সাহাবীদের তাফসীর হল মারফূ হাদিসের ন্যায়। ইমাম হাকেম নিশাপুরী (ওফাত. ৪০৫হি.) বলেন- وَتَفْسِيرُ الصَّحَابِيِّ عِنْدَهُمَا مُسْنَدٌ - ‘‘ইমাম বুখারী মুসলিমের নিকট সাহাবীদের তাফসীর মারফূ হাদিসের ন্যায়।’’ (ইমাম হাকেম নিশাপুরী : আল-মুস্তাদরাক : ১/২১১পৃ. কিতাবুল ইলম, হাদিস নং-৪২২, দারুল কুতুব ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন, প্রথম প্রকাশ. ১৪১১হি.) ইমাম নববী আশ্-শাফেয়ী (ওফাত. ৬৭৬হি.) বলেন- وَأَمَّا قَوْلُ مَنْ قَالَ: تَفْسِيرُ الصَّحَابِيِّ مَرْفُوعٌ - ‘‘সাহাবীদের কোরআনের কোন ব্যাখ্যা মারফূ হাদিসের ন্যায়।’’ (ইমাম নববী : আল-তাক্বরীব ওয়াল তাইসীর : ৩৪পৃ. দারুল কিতাব আরাবী, বয়রুত, লেবানন, প্রথম প্রকাশ. ১৪০৫হি.) বিশিষ্ট তাবেয়ী হযরত কাতাদা (رضي الله عنه) ও তাবেয়ী ইমাম মুজাহিদ (رحمة الله) সহ আর ও অনেকে বর্ণনা করেন যে আহলে বায়াতের অন্যতম সদস্য হযরত ইমাম আবু জাফর বাকের (رضي الله عنه) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন- عن قتادة رضى الله تعالى عنه ومجاهد وغيرهما قال ابو جعفر الباقر عليه السلام فضل الله رسول الله صلى الله تعالى عليه وسلم . -“আল্লাহর (ফদ্বল) বা অনুগ্রহ দ্বারা ও রাসূল (ﷺ) কে বুঝানো হয়েছে।” (ইমাম তিবরিসী, মাজমাউল বায়ান ৪/১৭৭-১৭৮ পৃ.।) শুধু তাই নয় উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম হাইয়্যান আন্দুলুসী (رحمة الله) (ওফাত. ৭৪৫হি.) বর্ণনা করেন- وَقَالَ ابْنُ عَبَّاسٍ فِيمَا رَوَى الضَّحَّاكُ عَنْهُ: الْفَضْلُ الْعِلْمُ وَالرَّحْمَةُ مُحَمَّدٌ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ. “তাবেয়ী ইমাম দাহ্হাক (رحمة الله) সাহাবী হযরত ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) হতে বর্ণনা করেন- উক্ত আয়াতে (ফদ্বল) দ্বারা ইলমকে এবং (রহমত) দ্বারা মুহাম্মদ (ﷺ) কে বুঝানো হয়েছে।” (ইমাম হাইয়্যান, তাফসীরে বাহারুল মুহিত, ৫/১৭১ পৃ.) বিশ্ব-বিখ্যাত মুহাদ্দিস ও তাফসিরকারক ইমাম যওজী (رحمة الله) (ওফাত.৫৯৭হি.) উক্ত আয়াতে সম্পর্কে লিখেন- ফাদ্বল দ্বারা ইলম বা জ্ঞানকে এবং রহমত দ্বারা মুহাম্মদ (ﷺ) কে বুঝানো হয়েছে যেমনটি তাবেয়ী ইমাম দাহ্হাক (رحمة الله) তাঁর শায়খ হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) থেকে বর্ণনা করেছেন।” (ইমাম যওজী, যা’দুল মাসীর ফি উলূমূত তাফাসীর, ৪/৪০ পৃ.) উক্ত আয়াতের রহমত এবং (فضل الله) ফাদ্বলুল্লাহ দ্বারাও রাসূল (ﷺ) কে বুঝানো হয়েছে বলে সাহাবী এবং তাবেয়ীদের তাফসীর দ্বারা প্রমাণ পাওয়া গেল। সুতরাং আলোচ্য আয়াত ও তাঁর তাফসীরের মাধ্যমে বুঝা গেল, মিলাদুন্নবী (ﷺ) বা রাসূল (ﷺ) এর দুনিয়ায় শুভাগমনের কারণে আল্লাহ্ পাক আমাদেরকে আনন্দ উৎসব বা খুশি উদ্যাপন করার নির্দেশ দিয়েছে তার নামই হল ঈদে মিলাদুন্নবী (ﷺ)। মহান রব ইরশাদ করেন- ‘‘যারা আল্লাহর নেয়ামতকে কুফুরী বশতঃ পরিবর্তন করেছে।’’ (সূরা ইব্রাহিম, আয়াত নং- ২৮) রাসূল (ﷺ) কে আল্লাহ এ আয়াতে নিয়ামত বলেছেন; আর নিয়ামতকে অস্বীকার করেছেন কারা সে সম্পর্কে ইমাম বুখারী (رحمة الله) উল্লেখ করেছেন- هم كفار أهل مكة -‘‘হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (رضي الله عنه) বলেন, যারা আল্লাহর নেয়ামত (রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কে) কুফুরী বশতঃ পরিবর্তন করেছে তারা হলেন মক্কার কুরাইশ গোত্রের কাফের গণ।’’ (বুখারী, আস্-সহিহ, ৬/৮০পৃ. হাদিস নং. ৪৭০০) সুতরাং যারা কুরআনে ঘোষিত হওয়ার পরও রাসূল (ﷺ) কে আল্লাহর রহমত বা অনুগ্রহ স্বীকার করতে চান না, তারা সুস্পষ্ট গোমরাহীর মধ্যে নিমজ্জিত। সম্মানিত পাঠকবৃন্দ! রাসূল (ﷺ) এর দুনিয়ায় আগমনের কারণে ঈদ বা আনন্দ উৎসব করার দলীল উপরের আয়াতে কারিমাগুলোতে আমরা ইতোমধ্যে পেলাম। আর ঈমানদারের জন্য এতটুকু এই দলিলই যথেষ্ট।

(১) ইমাম বুখারী (رحمة الله)-এর দাদা উস্তাদ ইমাম আব্দুর রাজ্জাক (ওফাত.২১১হি.) রাসূল (ﷺ)-এর মিলাদ বা সৃষ্টি সম্পর্কে একটি হাদিস সংকলন করেন এভাবে- عَنْ جَابِرٍ قَالَ: قُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ بِأَبِي أَنْتَ وَأُمِّي أَخْبِرْنِي عَنْ أَوَلَّ شَيْءٍ خَلَقَهُ اللَّهُ قَبْلَ الأَشْيَاءِ، فَقَالَ: يَا جَابِرُ! إِنَّ اللَّهَ خَلَقَ قَبْلَ الأَشْيَاءِ نُورُ نَبِيِّكَ مِنْ نُورِهِ، فَجَعَلَ ذَلِكَ النُّورِ يَدُورُ بِالْقُدْرَةِ حَيْثُ شَاءَ اللَّهُ، وَلَمْ يَكُنْ فِي ذَلِكَ الْوَقْتِ لَوْحٌ وَلا قَلَمٌ وَلا جَنَّةٌ وَلا نَارٌ وَلا مُلْكٌ وِلا سِمِاءٌ وَلا أَرْضٌ وَلا شَمْسٌ وَلا قَمَرٌ وَلا جِنِّيٌ وَلا إِنْسٌ. -‘‘হযরত জাবির বিন আব্দুল্লাহ (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত, তিনি বর্ণনা করেন, আমি নবী করিম (ﷺ) কে লক্ষ্য করে বললাম- হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ) আমার পিতা মাতা আপনার উপর কোরবান হোক। আমাকে কি আপনি অবহিত করবেন যে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কোন বস্তু সর্বপ্রথম সৃষ্টি করেছেন? তদুত্তরে রাসূলে করিম (ﷺ) ইরশাদ করেন- হে জাবির! সমস্ত বস্তুর সৃষ্টির পূর্বে আল্লাহ তোমার নবীর নূরকে তাঁর আপন নূর হতে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ পাকের ইচ্ছায় ঐ নূর কুদরতে যেথায় সেথায় ভ্রমণ করতেছিল। ঐ সময় লওহ-কলম, বেহেস্ত-দোজখ, ফেরেশতা, আসমান-জমীন, চন্দ্র-সূর্য, জিন-ইনসান কিছুই ছিল না।’’ (ইমাম আবদুর রায্যাক : আল-মুসান্নাফ (জুযউল মুফকুদ) : ১/৬৩, হাদিস-১৮, (ঈসা মানে হিমইয়ারা সংকলিত), আল্লামা আজলুনী : কাশফুল খাফা : ১/৩১১পৃ. হাদিস : ৮১১, আল্লামা কুস্তালানী : মাওয়াহেবে লাদুন্নিয়া : ১/১৫, মাকতুবাতুল ইসলামী, বয়রুত, লেবানন, আল্লামা জুরকানী: শরহুল মাওয়াহেব : ১/৮৯, আশরাফ আলী থানবী : নশরুত্ত্বীব : পৃ. ২৫, আব্দুল হাই লাখনৌভী, আসারুল মারফূআ,৪২-৩৩পৃ. ইবনে হাজার মক্কী, ফতাওয়ায়ে হাদিসিয়্যাহ, ৪৪পৃ. (শামেলা), শায়খ ইউসুফ নাবহানী, হুজ্জাতুল্লাহিল আলামিন: ৩২-৩৩পৃ. ও জাওয়াহিরুল বিহার, ৩/৩৭পৃ. আনোওয়ারে মুহাম্মাদিয়্যা, ১৯পৃ. মোল্লা আলী ক্বারী, মাওয়ারিদুর রাভী, ২২পৃ. ইমাম নববী, আদ্-দুরারুল বাহিয়্যাহ, ৪-৮। এ হাদিসের আরও রেফারেন্স বিস্তারিত জানতে আমার লিখিত ‘‘প্রমাণিত হাদিসকে জাল বানানোর স্বরূপ উন্মাচন’’ এর ১ম খন্ডের ২৯৩-৫৭৪পৃষ্ঠা দেখুন) এ হাদিসে রাসূল (ﷺ) তাঁর শুভাগমনের সূচনা কিভাবে হয়েছিল তা আলোকপাত করেছেন। এ হাদিস ও বিষয় সম্পর্কে আপত্তির নিষ্পত্তি বিস্তারিত জানতে আমার লিখিত [‘‘প্রমাণিত হাদিসকে জাল বানানোর স্বরূপ উন্মোচন’’ ১ম খন্ডে ৩৪৩-৩৭১পৃষ্ঠা দেখুন।] -‘‘হাদিস শাস্ত্রের প্রখ্যাত ইমাম আবু ঈসা মুহাম্মদ তিরমিযী (رحمة الله) তাঁর সংকলিত ‘সুনানে তিরমিযী’ শরীফে একটি অধ্যায়ের মধ্যে بَابُ مَا جَاءَ فِي مِيلاَدِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلم ‘মিলাদুন্নবী (ﷺ) শিরোনামে একটি পরিচ্ছেদ প্রণয়ন করেছেন এবং এতে হুজুর (ﷺ) এর জন্ম তারিখ নিয়ে আলোচনা সম্বলিত হাদিস বর্ণনা করেছেন। হাদিসটি হলো-হযরত মোত্তালিব ইবনে আব্দুল্লাহ আপন দাদা কায়েস বিন মোখরামা (رضي الله عنه) হতে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেন- আমি ও নবী করিম (ﷺ) ‘আমুল ফীল’ অর্থাৎ, বাদশাহ আবরাহার হস্তি বাহিনীর উপর আল্লাহর গযব নাজিল হওয়ার বছর জন্মগ্রহণ করেছি। হযরত ওসমান বিন আফ্ফান (رضي الله عنه) বনি ইয়ামার ইবনে লাইস এর ভাই কুবাছ ইবনে আশইয়ামকে বললেন- ‘আপনি বড় না রাসূল (ﷺ) ? তখন তিনি বললেন, রাসূল আমার চেয়ে অনেক বড় সম্মান ও মর্যাদার দিক থেকে, আর আমি জন্ম সূত্রে রাসূল (ﷺ) থেকে আগে মাত্র।’’ (তিরমিযী, আস্-সুনান, ৫/৫৮৯ পৃ. হাদিস নং. ৩৬১৯, দারুল গুরুবুল ইসলামী, বয়রুত, লেবানন, প্রকাশ. ১৯৯৮খৃ.।) এ হাদিসটিকে ইমাম তিরমিযি (رحمة الله) ‘হাসান’ বলেছেন। এ হাদিস থেকে দুটি বিষয় প্রমাণিত হল (১) সাহাবীদের যুগে বিভিন্ন স্থানে মিলাদুন্নবী (ﷺ)-এর আলোকপাত হত (২) আর যারা বলেন মিলাদুন্নবী (ﷺ) বলতে কোনো কথা কুরআন হাদিসে নেই ইমাম তিরমিযি (رحمة الله) তাদের মুখোশ উন্মোচন করে দিয়েছেন মিলাদুন্নবী (ﷺ) অধ্যায় রচনা করে। নিন্মের এ হাদিসে নবীজি নিজেই তার মিলাদুন্নবী (ﷺ)-এর আলোচনা করেছেন। عَن العِرْباض بن ساريةَ عَنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنَّهُ قَالَ... وَسَأُخْبِرُكُمْ بِأَوَّلِ أَمْرِي دَعْوَةُ إِبْرَاهِيمَ وَبِشَارَةُ عِيسَى وَرُؤْيَا أُمِّي الَّتِي رَأَتْ حِينَ وَضَعَتْنِي وَقَدْ خَرَجَ لَهَا نُورٌ أَضَاءَ لَهَا مِنْهُ قصر الشام… (رواية في شرح ااسنة) (৪) -‘‘হযরত ইরাবাদ বিন ছারিয়া (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত, তিনি হযরত নবী করিম (ﷺ) হতে বর্ণনা করেন...আমি হযরত ইব্রাহিম (عليه السلام) এর দোয়া হযরত ঈসা (عليه السلام) এর সুসংবাদ। আমার মাতা যখন আমাকে প্রসব করলেন তখন যে নূর বের হয়েছিল তাতে শাম দেশের কোঠা তিনি দেখতে পেয়েছেন। আমি সেই স্বপ্ন বা দৃশ্য।’’ (খতিব তিবরিযি, মিশকাতুল মাসাবিহ, ৩/১৬০৪পৃ. হাদিস নং. ৫৭৫৯, মাকতুবাতুল ইসলামী, বয়রুত, লেবানন, ১৯৮৫খৃ. আলবানী এ হাদিসটিকে মিশকাতের তাহকীকে সহিহ বলেছেন, হাকিম, মুস্তাদরাক, ২/৬৫৬পৃ. হাদিস নং. ৪১৭৪, ইবনে কাসির, বেদায়া ওয়ান নিহায়া, ২/৮৫পৃ. ও ২৭৫পৃ. ও তাফসীরে ইবনে কাসির, ৪/৩৬১পৃ.) এ হাদিসটিকে আহলে হাদিসের ইমাম নাসিরুদ্দীন ইমাম আলবানী স্বয়ং সনদটিকে সহিহ বলেছেন। (এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে আমার লিখিত ‘রাসূল (দ.)-এর সৃষ্টি নিয়ে বিভ্রান্তির অবসান’’ দেখুন) এ হাদিসটি অসংখ্য সনদে বর্ণিত আছে। عَن الْعَبَّاس أَنَّهُ جَاءَ إِلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَكَأَنَّهُ سَمِعَ شَيْئًا فَقَامَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلَى الْمِنْبَرِ فَقَالَ:مَنْ أَنَا؟ فَقَالُوا: أَنْتَ رَسُولُ اللَّهِ. فَقَالَ:أَنَا مُحَمَّدُ بْنُ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَبْدِ الْمُطَّلِبِ إِنَّ اللَّهَ خَلَقَ الْخَلْقَ فَجَعَلَنِي فِي خَيْرِهِمْ ثمَّ جعلهم فرقتَيْن فجعلني فِي خير فِرْقَةً ثُمَّ جَعَلَهُمْ قَبَائِلَ فَجَعَلَنِي فِي خَيْرِهِمْ قَبيلَة ثمَّ جعله بُيُوتًا فَجَعَلَنِي فِي خَيْرِهِمْ بَيْتًا فَأَنَا خَيْرُهُمْ نفسا وَخَيرهمْ بَيْتا . رَوَاهُ التِّرْمِذِيّ- -‘‘হুজুর করিম (ﷺ) এর চাচা হযরত আব্বাস (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, একদা তিনি হুযুর (ﷺ) এর নিকট ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আসলেন। কারণ তিনি যেন হুযুর করিম (ﷺ) এর বংশ বুনিয়াদ সম্পর্কে বিরূপ কিছু মন্তব্য শুনেছেন। (তা হুযুর করিম (ﷺ) কে অবহিত করলেন।) তখন হুজুর (ﷺ) মিম্বর শরীফের উপর আরোহন করলেন। (বরকতময় ভাষন দেয়ার উদ্দেশ্যে) অতঃপর তিনি সাহাবা কেরামগণের উদ্দেশ্যে বললেন “আমি কে ?” উত্তরে তাঁরা বললেন “আপনি আল্লাহর রাসূল”। তখন হুজুর আকরাম (ﷺ) এরশাদ করলেন “আমি আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল মুত্তালিবের পুত্র মুহাম্মদ (ﷺ)। নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা মানব-দানব সবই সৃষ্টি করেছেন। এতেও আমাকে উত্তম পক্ষের (অর্থাৎ মানবজাতি) মধ্যে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তাদের (মানব জাতি) কে দু ‘সম্প্রদায়ে বিভক্ত করেছেন (অর্থাৎ আরবীয় ও অনারবীয়) এতেও আমাকে উত্তম দু‘সম্প্রদায়ে (আরবী) সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর আরব জাতিকে অনেক গোত্রে বিভক্ত করেছেন। আর আমাকে গোত্রের দিক দিয়ে উত্তম গোত্রে (কুরাইশ) এ রেখেছেন করেছেন। তারপর তাদেরকে (কুরাইশ) বিভিন্ন উপগোত্রে ভাগ করেছেন। আর আমাকে উপগোত্রের দিক দিয়ে উত্তম উপগোত্রে (বনি হাশেম) সৃষ্টি করেছেন। সুতরাং আমি তোমাদের মধ্যে সত্তাগত, বংশগত ও গোত্রগত দিক থেকে সর্বশ্রেষ্ঠ।’’ ইমাম তিরমিযি এ সনদটিকে ‘হাসান’ বলে উল্লেখ করেছেন। (তিরমিযী, আস্-সুনান, ৬/৮ পৃ. হাদিস নং. ৩৬০৮; খতিব তিবরিযি, মিশকাতুল মাসাবিহ, - ৫১৩ পৃ.) আলোচ্য হাদিস দ্বারা স্পষ্ট ভাবে বুঝা গেল রাসূল (ﷺ) স্বীয় মিলাদুন্নবী (ﷺ) বা জন্ম বৃত্তান্ত বর্ণনা করে নিজের বংশগত শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছেন। عن ابن عباس رضى الله عنهما انه كان يحدث ذات يوم فى بيته وقائع ولادته صلى الله عليه وسلم قال حلت لكم شفاعتي - -‘‘হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) হতে বর্ণিত, একদা তিনি হুযুর (ﷺ) এর পবিত্র মিলাদের বা জন্মের ঘটনা বর্ণনা করছিলেন। এমন সময় নবী করিম (ﷺ) সেখানে তাশরীফ আনলেন এবং তা দেখে এরশাদ করলেন- “তোমাদের জন্য কেয়ামত দিবসে আমার শাফা’য়াত ওয়াজিব হয়ে গেল”। (অর্থাৎ সমবেত হয়ে আমার জন্ম বৃত্তান্ত বর্ণনার ফলে তোমাদের জন্য কিয়ামত দিবসে আমার সুপারিশ নিশ্চিত হয়ে গেলো।’’ (ইবনে দাহিয়াহ, আত্তানবীর ফিল মাওলিদিল বাশীরিন্নাযীর, ৭৭পৃ. )। عن ابى الدرداء رضى الله عنه انه مر مع النبى صلى الله عليه وسلم إلى بيت عامر الأنصاري وكان يعلم وقائع ولادته صلى الله عليه وسلم لابنائه وعشيرته ويقول هذا اليوم هذا اليوم فقال عليه الصلوة والسلام ان الله فتح لك أبواب الرحمة والملائكة يستغفرون لك ومن فعل فعلك نجانجا تك - (৮) -‘‘হযরত আবু দারদা (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত, একদা তিনি হুযুর করিম (ﷺ) এর সাথে হযরত আমের আনসারী (رضي الله عنه) এর ঘরে গিয়েছিলেন। তখন হযরত আমের আনসারী (رضي الله عنه) তাঁর সন্তান ও স্বগোত্রীয় লোকদের সাথে নিয়ে মিলাদুন্নবী (ﷺ) বা হুযুর করিম (ﷺ) এর জন্ম বৃত্তান্ত আলোচনা করছিলেন এবং বলছিলেন- “এই দিনটি, এই দিনটি” তখন হুযুর (ﷺ) এরশাদ করেলেন- “(হে আমের আনসারী!) নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা তোমার জন্য রহমতের দরজা সমূহ খুলে দিয়েছেন। আর ফিরিশতাগণ তোমার জন্য মাগফেরাত কামনা করছে। তাছাড়া যারা তোমার মতো আমার মিলাদুন্নবী (ﷺ) বা জন্ম বৃত্তান্ত বর্ণনা করবে তারা তোমার মতোই নাজাত লাভ করবে। (ইবনে দাহিয়াহ, আত্তানভীন ফী মাওলিদিল বাশীরিন্নাযীর, ৭৮পৃ. ) আলোচ্য হাদিস দু’টি থেকে প্রমাণিত হয় যে, সাহাবায়ে কেরাম (رضي الله عنه) হুজুর (ﷺ) এর মিলাদ বা জন্ম বৃত্তান্ত আলোচনা করতেন এবং তা নিজ সন্তান ও স্বগোত্রীয়দের শিক্ষা দিতেন। এ দুটি হাদিস ও বিষয় সম্পর্কে আপত্তির নিষ্পত্তি বিস্তারিত জানতে আমার লিখিত ‘‘প্রমাণিত হাদিসকে জাল বানানোর স্বরূপ উন্মোচন’’ ১ম খন্ডে ৫১১-৫১৭ পৃষ্ঠা দেখুন।

রাসূল (ﷺ) মিলাদুন্নবী (ﷺ) পালন করার ব্যাপারে উৎসাহিত করেছেন। হাদিস শরীফটি হলো নিম্নরূপঃ عَنْ أَبِي قَتَادَةَ الْأَنْصَارِيِّ، رَضِيَ اللهُ عَنْهُ أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ سُئِلَ عَنْ صَوْمِ الِاثْنَيْنِ؟ فَقَالَ: فِيهِ وُلِدْتُ - (৯)-‘‘হযরত আবু কাতাদাহ (رضي الله عنه) হতে বর্ণিত, তিনি বর্ণনা করেন, রাসূলে করিম (ﷺ) কে সোমবার রোযা রাখা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে, তার উত্তরে রাসূলে করিম ((ﷺ)) বললেন “এ দিন আমার মিলাদুন্নবী (ﷺ) অর্থাৎ এ দিন আমি জন্মগ্রহণ করেছি।’’ (মেশকাত শরীফ- ১৭৯ পৃ; মুসলিম শরীফ- ১/৩৬৮ পৃ.) আলোচ্য হাদিস শরীফের মাধ্যমে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো রাসূল (ﷺ) শোকরিয়া স্বরূপ রোজা রেখে সাপ্তাহিক মিলাদুন্নবী (ﷺ) পালন করেছেন।

(১ ) হযরত আবু বকর সিদ্দীক (رحمة الله) এরশাদ করেছেন- قَالَ اَبُوْ بَكْرِ الْصِّدِّيْق ؓ مَنْ اَنْفَقَ دِرْ هَمًاعَلٰى قِرَاءَةِ مَوْلِدِ النَّبِىَ ﷺ كَانَ رَفِيْقِى فِى الْجَنَّةِ- -“যে ব্যক্তি নবী করীম ﷺ এর মীলাদ-ই-পাকের জন্য একটি মাত্র দিরহাম খরচ করবে, সে (যদি সে ঈমানদার হয়) জান্নাতে আমার সঙ্গী হবে।” (ইবনে হাজার মক্কী, আন-নি‘আমাতুল কুবরা আলাল আলাম, পৃষ্ঠা নং- ৭, মীর মুহাম্মদ কারখানা, করাচী, পাকিস্তান এবং মাকতুবাতুল হক্কীয়্যাহ, তুরস্ক) ২- হযরত ওমর ফারুক (رحمة الله) এরশাদ করেছেন- قَالَ عُمَرَ مَنْ عَظَّمَ مَوْلِدَ النَّبِىِّ ﷺ فَقَدْ اَحْيَا الْاِسْلَامَ- “যে ব্যক্তি নবী করীম (ﷺ) এর মীলাদ-ই-পাককে সম্মান ও মযাদা দান করেছে সে নিশ্চয় ইসলামকে জীবিত করেছে।” (আন নেয়ামাতুল কুবরা আলাল আলাম পৃষ্ঠা নং- ৭।) এ দুটি হাদিস ও এ বিষয় সম্পর্কে বাতিলদেও আপত্তির নিষ্পত্তি জানতে আমার লিখিত ‘‘প্রমাণিত হাদিসকে জাল বানানোর স্বরূপ উন্মোচন’’ ১ম খন্ডে ১৬৯-১৭২-৫১৭ পৃষ্ঠা দেখুন।

১. মুহাদ্দিস ইমাম ইবনুল জাওযী (رحمة الله) (ওফাত. ৫৯৭ হি.) বলেন- لا زال أهل الحرمين الشريفين والمصر واليمن والشام وسائر بلاد العرب من المشرق والمغرب يحتفلون بمجلس مولد النبى صلى الله عليه وسلم ويفرحون بقدومه هلال شهر ربيع الأول و يهتمون اهتماما بليغا على السماع والقراءة لمولد النبى صلى الله عليه وسلم وينالون بذلك أجرا جزيلا وفوزا عظيما- “মক্কা, মদীনা, ইয়ামন, শাম ও তামাম ইসলামী বিশ্বের পূর্ব ও পশ্চিমবাসীরা সবসময় হুজুর (ﷺ) এর বেলাদাত শরীফের ঘটনায় মীলাদ মাহফিল আয়োজন করত। তারা রবিউল আউয়াল মাসের নতুন চাঁদ উদিত হলে খুশি হয়ে যেত এবং হুজুরের মিলাদ শুনা ব্যাপারে ও পড়ার সীমাহীন গুরুত্বারোপ করত। আর মুসলমানগণ এসব মাহফিল কায়েম করে পরিপূর্ণ প্রতিদান ও আধ্যত্মিক কামিয়াবী হাছিল করত।” (ইমাম যওজী, বয়ানুল মিলাদুন্নবী- ৫৮ পৃ.) ৩. ইমামুল হাফেজ সাখাভী (رحمة الله) বলেন- لا زال أهل الإسلام في سائر الأقطار والمدن الكبار يحتفلون في شهر مولده صلى الله عليه وسلم بعمل الولائم البديعة المشتملة -“বিশ্বের চতুর্দিকে ও শহরগুলোতে হুজুর (ﷺ) এর জন্ম গ্রহণের মাসে মুসলমানরা বড় বড় আনন্দনুষ্ঠান করে থাকে।” (মোল্লা আলী ক্বারী, মাওয়ারিদুর রাবী, ইবনে সালেহ শামী, সবলুল হুদা ১/ ৩৬২ পৃ. ) ৪. ইমাম জালালুদ্দীন সূয়ূতী (رحمة الله) বলেন- عِنْدِي أَنَّ أَصْلَ عَمَلِ الْمَوْلِدِ الَّذِي هُوَ اجْتِمَاعُ النَّاسِ وَقِرَاءَةُ مَا تَيَسَّرَ مِنَ الْقُرْآنِ وَرِوَايَةُ الْأَخْبَارِ الْوَارِدَةِ فِي مَبْدَأِ أَمْرِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَمَا وَقَعَ فِي مَوْلِدِهِ مِنَ الْآيَاتِ، ثُمَّ يُمَدُّ لَهُمْ سِمَاطٌ يَأْكُلُونَهُ وَيَنْصَرِفُونَ مِنْ غَيْرِ زِيَادَةٍ عَلَى ذَلِكَ - هُوَ مِنَ الْبِدَعِ الْحَسَنَةِ الَّتِي يُثَابُ عَلَيْهَا صَاحِبُهَا لِمَا فِيهِ مِنْ تَعْظِيمِ قَدْرِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَإِظْهَارِ الْفَرَحِ وَالِاسْتِبْشَارِ بِمَوْلِدِهِ -“আমার মতে মিলাদের জন্য সমাবেশ করা, তেলাওয়াতে কোরআন, হুজুর (ﷺ) এর পবিত্র জীবনের বিভিন্ন ঘটনাবলী এবং জন্ম গ্রহণকালীন গঠিত নানান আলামত সমূহের আলোচনা করা এমন বেদআতে হাছানার অন্তর্ভুক্ত; যে সব কাজের ছওয়াব দেয়া হয়। কেননা এতে হুজুর (ﷺ) এর তা’জিম, মোহাব্বত এবং তাঁর আগমনের খুশী জাহির করা হয়।” (ইমাম সুয়ূতি, আল-হাভীলিল ফাতওয়া, ১/২২১পৃ.) ৫. ইমাম হাফেজ ইবনে হাজর মক্কী (رحمة الله) বলেন- الموالد والأذكار الَّتِي تفعل عندنَا أَكْثَرهَا مُشْتَمل على خير، كصدقة، وَذكر، وَصَلَاة وَسَلام على رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وَسلم -“আমাদের এখানে মিলাদ মাহফিল জিকর-আজকার যা কিছু অনুষ্ঠিত হয়, তার অধিকাংশই ভাল কাজের অন্তর্ভুক্ত। যেমন, সাদকা করা, জিকির করা, দরুদ পড়া, ও রাসূলে পাক (ﷺ) এর উপর ছালাম পেশ করা।” (ইবনে হাজার মক্কী, ফাতওয়া হাদিসিয়্যাহ, ১/১০৯ পৃ. দারুল ফিকর ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন।) ৬. বুখারী শরীফের ব্যাখ্যাকার আল্লামা ইমাম কুস্তালানী (رحمة الله) লিখেন- ولا زال أهل الاسلام يحتفلون بشهر مولوده صلى الله عليه وسلم ويعملون الولائم ويتصد قون فى لياليه بانواع الصدقات ويظهرون السرور ويزيدون فى المبرات ويعتنون بقرأة مولده الكريم ويظهر عليهم من بركاته كل فضل عميم – -‘‘প্রতিটি যুগে মুসলমানগণ নবী করীম (ﷺ) এর বেলাদাত শরীফের মাসে মীলাদ মাহফিলের আয়োজন করে আসছে, উন্নত মানের খাবারের আয়োজন করেন, এর রাতগুলোতে বিভিন্ন ধরণের সাদক্বাহ খায়রাত করেন, আনন্দ প্রকাশ করতে থাকেন, পুন্যময় কাজ বেশি পরিমাণে করার প্রতি গুরুত্ব দিয়ে আসেন। ফলে আল্লাহর অসংখ্য বরকত ও ব্যাপক অনুগ্রহ প্রকাশ পায়।’’ (আল্লামা ইমাম যুরকানী : শরহুল মাওয়াহেব : ১ম খন্ড : ২৬২ পৃষ্ঠা) ৭. আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী (رحمة الله) বলেন- لازال اهل الاسلام يختلفون فى كل سنة جديدة ويعتنون بقراءة مولده الكريم ويظهر عليهم من بركاته كل فضل عظيم. -‘‘মুসলমানগণ প্রতি নববর্ষে মাহফিল করে আসছেন এবং তাঁরা মীলাদ পাঠের আয়োজন করেন। এর ফলে তাদের প্রতি অসীম রহমতের প্রকাশ ঘটে।’’ (মোল্লা আলী ক্বারী, মাওয়ারিদুর রাভী, ৫ পৃ. ) ৮. তাফসীরে রুহুল বায়ান প্রণেতা আল্লামা ইসমাঈল হাক্কী (رحمة الله) বলেন- ومن تعظيمه عمل المولد إذا لم يكن فيه منكر قال الامام السيوطي قدس سره يستحب لنا اظهار الشكر لمولده عليه السلام -‘‘মীলাদ শরীফ করাটা হুযুর (ﷺ)-এর প্রতি সম্মান, যদি এটা মন্দ কথা বার্তা থেকে মুক্ত হয়। ইমাম সুয়ূতি (رحمة الله) বলেন, হুযুর (ﷺ)-এর বেলাদাতের শুকরিয়া জ্ঞাপন করা আমাদের জন্য মুস্তাহাব।’’ (ইসমাঈল হাক্কী, রুহুল বায়ান, ৯/৫৬পৃ. দারুল ফিকর ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন।) ৯. শায়খ আব্দুল হক মোহাদ্দেসে দেহলভী (رحمة الله) বলেন- لا يزال اهل الاسلام يحتفلون بشهر مولده صلى الله عليه وسلم ويعملون الولائم ويتصدقون فى لياليه بانواع الصدقات ويظهرون السرور ويزيدون فى المبرات ويعتنون بقراء مولده الكريم- -“হুজুর (ﷺ) এর পবিত্র বেলাদতের মাসে মিলাদ-মাহফিলের আয়োজন সমগ্র মুসলিম বিশ্বে সর্বদাই পালিত হয়ে আসছে। ঐ মাসের রাত্রিতে দান ছদকা করে, আনন্দ প্রকাশ করে এবং ঐ স্থানে বিশেষভাবে নবীর আগমনের উপর প্রকাশিত বিভিন্ন ঘটনাবলীর বর্ণনা করা মুসলমানদের বিশেষ আমল সমূহের অন্তর্ভুক্ত।” (শায়খ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী, মা সাবাতা বিসুন্নাহ, ৬০পৃ.) ১০. শাহ্ ওয়ালী উল্লাহ্ মোহাদ্দেসে দেহলভী (رحمة الله) বলেন- وكنت قبل ذالك بمكة المعظمة فى مولد النبى صلى الله عليه وسلم فى يوم ولادته والناس يصلون على النبى صلى الله عليه وسلم - -“মক্কা মোয়াজ্জামায় হুজুর (ﷺ) এর বেলাদত শরীফের দিন আমি এমন একটি মিলাদ মাহফিলে শরীক হয়েছিলাম, যাতে লোকেরা হুজুরের দরগাহে দুরূদ-ছালাতের হাদিয়া পেশ করছিল।” (শাহ ওয়ালী উল্লাহ দেহলভী, ফয়জুল হারামাঈন, ৮০-৮১পৃ.) ১১. অন্যত্র তিনি স্বীয় পিতা হযরত শাহ্ আব্দুর রহীম দেহলভী (رحمة الله) এর সূত্রে উল্লেখ করে বলেন- كنت اصنع في أيام المولد طعاما صلة بالنبي صلى الله عليه وسلم فلم يفتح لي سنة من السنين شئ اصنع به طعاما فلم اجد الا حمصا مقليا فقسمته بين الناس فرأيته صلى الله عليه وسلم بين يديه هذا الحمص مبتهجا وبشاشا- -“আমি প্রতি বছর হুজুর (ﷺ) এর মিলাদে মাহফিলে খানার ব্যবস্থা করতাম। কিন্তু এক বছর আমি খাবার যোগাড় করতে পারিনি। তবে কিছু ভুনা করা চনাবুট পেয়েছিলাম। অতঃপর আমি তা মিলাদে আগত মানুষের মধ্যে বন্টন করে দিলাম। পরে আমি স্বপ্নে হুজুর (ﷺ)কে বড়ই খোশ হাসেল তাশরিফ আনতে দেখলাম এবং তার সামনে মওজুদ রয়েছে উক্ত চনাবুট (যা আমি বন্টন করেছিলাম)।” (শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী, আদ-দুরুরুস সামীন, ৪০পৃ. ) ১২. আহলে হাদিসের ইমাম ইবনে তাইমিয়া বলেন- فتعظيم المولد، واتخاذه موسمًا، قد يفعله بعض الناس، ويكون له فيه أجر عظيم لحسن قصده، وتعظيمه لرسول الله صلى الله عليه وسلم، كما قدمته لك أنه يحسن من بعض الناس، ما يستقبح من المؤمن المسدد. -“আমি ইতোপূর্বে আলোচনা করছি যে মিলাদকে মানুষেরা মৌসুমীভাবে পালন করে তা’জিম করে থাকে, এতে তাদের অনেক সাওয়াব হবে। আর এটাও সুস্পষ্ট যে, কিছু লোক এটাকে হাসান মনে করে, কারণ সঠিক মু’মিন ব্যক্তি মন্দ কাজ করে না।” (ইবনে তাইমিয়া, একতেদ্বাউল সিরাতাল মুস্তাকিম ২/১২৬ পৃ. দারুল আ‘লামুল কিতাব, বয়রুত, লেবানন) ১৩. দেওবন্দীদের পীরানে পীর হাজী এমদাদুল্লাহ মুহাজের মক্কী (رحمة الله) বলেন- ہمارے علماء مولد شريف میں بہت تنازعه كرتے ہیں تاہم علماء جواز كى طرف بہى گۓ ہیں - جب صورت جواز كى موجود ہے پہر كيوں ايسا تشدد كر تے ہيں اور ہمارے واسطے اتباع حرمين كافى ہے- -“আমাদের আলেমগণ মওলুদ শরীফ নিয়ে অনেক ঝগড়া করে থাকে। এরপরেও আলেমগণ কিন্তু জায়েযের পক্ষে মত ব্যক্ত করেছেন। যখন জায়েযের ছুরত রয়ে গেছে, তো এত বাড়াবাড়ির কি প্রয়োজন। আমাদের জন্য হারামাঈনের অনুসরণ করাই যথেষ্ঠ।” (হাজী এমদাদুল্লাহ মুহাজেরে মক্কী, কুল্লিয়াতে এমদাদিয়া, ২০৭পৃ. ফয়সালায়ে হাফতে মাসায়েল, ৭-৮ পৃ.) হযরত হাজী সাহেব (رحمة الله) ফয়সালায়ে হাফতে মাসয়ালা গ্রন্থে নিজের আমলও বর্ণনা করে দিয়েছেন- فقير مشرب يہ ہے محفل مولد میں شريك ہوتا بلكہ بركات كا ذريعہ سمجہ كر ہر سال منعقد كرتا ہوں اور قيام میں لطف اور لذت پا ہوں -“এই ফকীরের নিয়ম হল এই যে, আমি মওলুদ মাহফিলে অংশ গ্রহণ করি, এমনকি বরকতের ওসিলা মনে করে প্রতি বছর উক্ত অনুষ্ঠান করে থাকি এবং কিয়ামের মধ্যে লুতফ (ভালবাসা) ও লাজ্জাত (স্বাদ) পেয়ে থাকি।” (হাজী এমদাদুল্লাহ মুহাজেরে মক্কী, কুল্লিয়াতে এমদাদিয়া, ২০৭ পৃ., ফয়সালায়ে হাফতে মাসায়েল, ৭-৮ পৃ.) দেওবন্দীদেরকে বলবো যে নিজের পীরানে পীরকে মানেন না তো কেমন আদব ওয়ালা মুরীদ আপনারা?

বিশ্ব বিখ্যাত ফকীহ ইমাম তাহাবী (رحمة الله) ইমাম শাওয়াফে (رحمة الله) এর কওল নকল করে লিখেন- إن أفضل الليالي ليلة مولده صلى الله عليه وسلم ثم ليلة القدر- -‘‘নিশ্চয়ই ইবাদতের মধ্যে সবচেয়ে উত্তম রাত হলো ঈদে মিলাদুন্নবী (ﷺ) এর রা তবা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর শুভাগমনের রাত্র (১২ই রবিউল আউয়াল) তারপর হলো শবেই কদরের রাত্র।’’ (আল্লামা শায়খ ইউসূফ নাবহানী : যাওয়াহিরুল বিহার : ৩/৪২৬ পৃ : মারকাযে আহলে সুন্নাহ বি বারকাতে রেযা, গুজরাট হতে প্রকাশিত।) ইমাম শায়খ ইউসুফ বিন ইসমাঈল নাবহানী (رحمة الله) লিখেন- وليلة مولده صلى الله عليه وسلم أفضل من ليلة القدر -‘‘শবে ক্বদর হতে মিলাদুন্নবী (ﷺ)-এর রাত উত্তম।’’ (আল্লামা শায়খ ইউসূফ নাবহানী : আনওয়ারে মুহাম্মাদিয়াহ, ২৮পৃ. দারুল কুতুব ইলমিয়্যাহ, বয়রুত, লেবানন।) ইমাম কুস্তালানী (رحمة الله)ও অনুরূপ বলেছেন এবং এর তিনটি কারণ উল্লেখ করেছেন। (আল্লামা কুস্তালানী : মাওয়াহেবে লাদুনিয়্যাহ, ২৮১/১৪৫পৃ. মাকতুবাতুত তাওফিকহিয়্যাহ, কায়রু, মিশর।)

আপনার পছন্দের আর দেখুন
WhatsApp Channel Join Now
Telegram Group Join Now

Post a Comment

Assalamu Alaikum Wa Rahmatullah
Greetings!
Provide your feedback.