ক্বুত্বব উদ্দীন। ‘বখতয়িার’ খাজা গরীব নাওয়াজ রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হির প্রদত্ত ‘খেতাব’। ‘কাকী’ প্রসিদ্ধ লক্বব (উপাধী)। বরকতময় জন্ম- ৫৬৯ হিজরী। জন্মস্থান আউশ (ইরাক্ব)। ওফাত দিবস- ১৪ রবিউল আউয়াল ৬৩৩ হিজরী, মোতাবেক ২৭ নভেম্বর, ১১২৫ খ্রিস্টাব্দ। ওফাতের স্থান মেহের ওলী শরীফ, দিল্লী।
খাজা-ই খাজেগান চিশতী ‘হযরত খাজা গরীব’ নাওয়াযের নায়েব ও খলীফা (জা-নশীন) বিধায় ক্বত্ববুল আক্বত্বাব হযরত খাজা ক্বুত্বব উদ্দীন বখতিয়ার কাকী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু ‘সিলসিলাহ্-ই চিশ্তীয়া মু‘ঈনিয়া’র সমস্ত শাখার সম্মানিত মাশাইখ ও ফয়যপ্রাপ্তদের আশ্রয়স্থল ও চূড়ান্ত ঠিকানা এবং সমস্ত ফয়য ও বরকেতর উৎসস্থলই।
জন্মের সময় আলোরাশির ছড়াছড়ি
‘সিয়ারুল আক্বতাব’-এর বর্ণনানুসারে অর্দ্ধরাতে তিনি এ নশ্বর পৃথিবীতে তাশরীফ আনেন। তাঁর জন্মের সময় সমগ্র ঘরে আলোরাশির ছড়াছড়ি ছিলো। তা তাঁর আলোর ভূ-খণ্ডে পরিণত হয়েছিলো। তাঁর মহিয়সী আম্মাজানকে অদৃশ্য জগৎ থেকে নিন্মলিখিত আওয়াজটুকু শুনানো হয়েছিলো-
ايں نور كه ديدى سرے بود از اسرار الهى- كه اكنوں دردل فرزندن نها ديم-
অর্থ: ‘‘এ নূর (আলো), যা তুমি দেখেছো, আল্লাহর রহস্যাদি থেকে একটি গূঢ় রহস্য, যাকে আমি তোমার এ সন্তানের বক্ষে স্থানান্তরিত করলাম।’’
‘কাকী’ উপাধি লাভের কারণ
‘কাক’ মানে রুটি। ‘কাকী’ মানে রুটি সংক্রান্ত কারামত বিশিষ্ট। এ উপাধি প্রাপ্তির কারণ হলো- দিল্লীতে অবস্থানকালে তিনি সব সময় আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন থাকতেন। আর কারো থেকে নযর-নিয়াযও গ্রহণ করতেন না। ফলে পরিবার-পরিজন অতি অর্থকষ্টে দিনাতিপাত করতেন। তাঁর মহিয়সী স্ত্রী প্রতিবেশী এক মুদি দোকানদারের স্ত্রী থেকে কর্জ নিয়ে পরিবার চালাতেন। একদিন ওই নারী তিরস্কারের ভাষায় বললো, ‘‘আমরা যদি তোমাদের প্রতিবেশি না থাকতাম, তবে তোমাদের ধ্বংস অনিবার্যভাবে লিপিবদ্ধ ছিলো।’’ একথা তিনি হযরতকে জানালেন। তিনি মনে খুব কষ্ট পান। তিনি এরশাদ করলেন, ‘‘ভবিষ্যতে কারো নিকট থেকে কর্জ নিওনা। প্রয়োজন হলে অমুক থাক থেকে পাকানো ‘নান’ (রুটি) নিয়ে নিও।’’ ফার্সি ভাষায় রুটিকে ‘কাক’ বলা হয়। তখন থেকে তাঁর উপাধি ‘কাকী’ হয়েছে।
‘বিস্মিল্লাহ্ খানি’র অনুষ্ঠান
হযরত কাকী আলায়হির রাহমার বয়স তখন মাত্র দেড় বছর ছিলো। তাঁর পিতার ছায়া মাথার উপর থেকে উঠে গেলো। সুতরাং তাঁর লালন-পালন ও লেখাপড়ার যাবতীয় দায়িত্ব তাঁর আম্মাজানের উপর এসে বর্তালো। যখন তাঁর বয়স শরীফ চার বছর চার মাস চারদিন হলো, তখন ওই সময়-কালের নিয়ম অনুসারে তাঁর আম্মাজান তাঁর ‘বিস্মিল্লাহ্ খানি’র অনুষ্ঠানের আয়োজন করলেন। সুন্দর ঘটনাচক্রে ওই সময়ে হযরত খাজা গরীব-নাওয়ায ভ্রমণ করতে করতে ‘আউশ’-এ তাশরীফ নিয়ে আসেন এবং তিনি সেখানে অবস্থান করছিলেন। তাঁর আম্মাজান এটাকে সুবর্ণ সুযোগ মনে করে আপন কলিজার টুকরা শিশু সন্তানকে ‘বিস্মিল্লাহ্ খানি’র জন্য হযরত খাজা গরীব নাওয়াযের পবিত্র দরবারে পাঠালেন। হযরত খাজা আলায়হির রাহমাহ্ যখনই ক্বুত্বব সাহেবের ‘তখ্তী’ (ফলক)গুলো লিখার ইচ্ছা করলেন, তখন অদৃশ্য থেকে আওয়াজ আসলো- ‘‘হে খাজা! লিখন স্তগিত করুন! ক্বাযী হামীদ উদ্দীন তাশরীফ নিয়ে আসছেন। তিনি তখন (ফলক) লিখনের কাজ সমাধা করবেন।’’
ইত্যবসরে ক্বাযী সাহেব তাশরীফ নিয়ে এসেছেন। তিনি তখ্তী নিজের নিকট নিলেন। আর হযরত শিশু ক্বুত্বব সাহেবকে জিজ্ঞাসা করলেন- কি লিখবো? তিনি তাৎক্ষণিকভাবে পঞ্চদশ পারার আয়াত পড়ে বললেন, ‘‘এটা লিখুন!’’ ক্বাযী সাহেব বললেন, ‘‘সাহেবযাদা! এ আয়াত আপনাকে কে মুখস্ত করিয়েছেন?’’ তিনি বললেন, ‘‘আমার মহিয়সী আম্মাজান পনের পারার হাফিয। আমাকে গর্ভে ধারণকালে যখন তিনি তিলাওয়াত করতেন, তখন আমি শুনতাম। এমনকি আমিও পনের পারার হাফেয হয়ে গিয়েছি।’’ এরপর ক্বাযী সাহেব মাত্র চার দিনে ক্বুত্বব সাহেবকে পূর্ণ ক্বোরআন মুখস্থ করিয়ে দিয়েছেন।
মক্তবে ভর্তি
যখন ক্বুত্বব সাহেবের বয়স শরীফ পাঁচ বছর হলো, তখন মিষ্টি ও কিছু টাকা দিয়ে তাঁর মহিয়সী আম্মাজান সাহেবযাদাকে মকতবে পাঠালেন। রাস্তায় এক বুযুর্গের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হলো। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, এ শিশুকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? বললেন, ‘‘মকতবে।’’ তিনি বললেন, ‘‘তাঁকে মাওলানা আবূ হাফ্সের নিকট নিয়ে যাও!’’ ওই বুযুর্গ নিজেও সাথে গেলেন। আর মাওলানাকে তাকিদ দিয়ে বললেন, ‘‘পূর্ণ মনযোগ সহকারে তাঁকে পড়াবেন। কারণ তাঁর দ্বারা বড় বড় কাজ সমাধা করা হবে।’’ যখন ওই বুযুর্গ চলে গেলেন, তখন মাওলানা যে লোকটি হযরত ক্বুত্বব সাহেবকে সাথে নিয়ে গিয়েছিলেন, (আবূ হাফস্) তাঁকে বললেন, ‘‘তুমি কি জানো ওই বুযুর্গ ব্যক্তি কে ছিলেন? তিনি হযরত খাদ্বির ছিলেন, যাঁকে আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ থেকে একাজের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছিলো।’’
যখন ক্বুত্বব সাহেবের শিক্ষাদান পরিপূর্ণ হলো এবং তিনি বালিগ হওয়ার বয়সে পৌঁছে গেলেন, তখন তিনি আল্লাহ্র ইশক্বের প্রতি আহ্বানকারীদের পথ প্রদর্শনের মধ্যে আল্লাহর তালাশে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। এক শহরে তাঁর সাক্ষাৎ হযরত খাদ্বির আলায়হিস্ সালাম-এর সাথে হয়ে গেলো। ওখান থেকে তিনি আরো এগিয়ে গেলেন। আর হযরত মাহমূদ ইসফাহানী নামের এক বুযুর্গের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হলো। তিনি তাঁর হাতে বায়‘আত হতে চাইলেন; কিন্তু আল্লাহ্ তা‘আলার ইচ্ছা অন্য কিছু ছিলো। ওই দিনগুলোতে ক্বুত্বব সাহেব জানতে পারলেন যে, হযরত খাজা মু‘ঈন উদ্দীন চিশ্তী ইসফাহান তাশরীফ এনেছেন। তিনি কাল বিলম্ব না করে সেখানে পৌঁছে গেলেন এবং তাঁর দরবারে হাযির হলেন। হযরত খাজা তখন রজাই মুড়িয়ে শয়ন রত ছিলেন। তিনি উঠে রজাইটি হযরত ক্বুত্বব সাহেবের মাথায় ও গায়ে মুড়িয়ে দিলেন। এটা একথার আলামত ছিলো যে, তিনি তাঁকে মুরীদ হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছেন।
ফলে ক্বত্ব্ব সাহেবের অন্তরেও আপন মুর্শিদের প্রতি এমন অকৃত্রিম গভীর ভালবাসা পয়দা হয়ে গেলো যে, সফরে এবং ঘর-বাড়িতে এক মুহূর্তের জন্যও তাঁর বিচ্ছেদ পছন্দ ও সহ্য হচ্ছিলো না। সুতরাং তিনি আপন মুর্শিদের সাথেই থাকতে লাগলেন।
হেরমাঈন শরীফাঈনে সফর
৫৮৩ হিজরী, মোতাবেক ১১৮৭ খ্রিস্টাব্দে হযরত ক্বুত্বব সাহেব আপন মুর্শিদের সাথে প্রথমে মক্কা মু‘আয্যামায় পৌঁছলেন। এখান থেকে এরপর মদীনা মুনাওয়ারায় হাযির হলেন। আপন মুর্শিদে করীমের বিশেষ কৃপা দৃষ্টিতে এ উভয় পবিত্র স্থানে তিনি অগণিত দয়া ও দান পেয়ে ধন্য হয়েছেন। মদীনা মুনাওয়ারায় কিছু দিন অবস্থান করার পর ৫৮৫ হিজরী মোতাবেক ১১৮৯ খ্রিস্টাব্দে বাগদাদ শরীফ চলে আসেন। এখানেও তিনি কিছু দিন অবস্থান করেছেন।
খিলাফত প্রাপ্তি
আল্লাহ্ তা‘আলার নির্দেশ ও রসূলে-ই আক্রাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর ফরমানের কারণে হযরত খাজা গরীব-নাওয়ায খাজা আবুল লায়স সমরকন্দীর মসজিদে তাঁর প্রিয় ও যোগ্য মুরীদ হযরত ক্বুত্বব সাহেবকে খিলাফত দান করে ধন্য করেন এবং সনদ হিসেবে ‘খিরক্বাহ্’ (বিশেষ চাদর) প্রদান করেছেন। তখন সেখানে হযরত শায়খ শিহাব উদ্দীন সুহ্রুওয়ার্দী, শায়খ দাঊদ কিরমানী ও শায়খ বোরহান উদ্দীন চিশ্তী প্রমুখ শীর্ষস্থানীয় ওলীগণও উপস্থিত ছিলেন। হযরত ক্বুত্বব সাহেবের ত্বরীক্বতের শাজরা ১৫শ সূত্রে মাওলা-ই কায়েনাত সাইয়্যেদুনা আলী মুরতাদ্বা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু পর্যন্ত পৌঁছে।
আজমীর শরীফে তাশরীফ আনয়ন
খিলাফতের অমূল্য রতœ লাভ করার পর ৫৮৫ হিজরী, মোতাবেক ১১৯০ খ্রিস্টাব্দে আপন আক্বা-ই নি’মাত মুর্শিদে বরহক্বের সাথে বাগদাদ শরীফ থেকে হিন্দুস্থানের উদ্দেশে রওনা হন। আর চিশ্ত, হিরাত ও সব্যেওয়ার হয়ে লাহোর এসে পৌঁছান। আর ওখান থেকে সুমানা ও দিল্লী হয়ে ৫৮৭ হিজরী, মোতাবেক ১১৯২ খ্রিস্টাব্দে আজমীর শরীফে এসে পৌঁছান। কিছু দিন আজমীর শরীফে অবস্থান করার পর হযরত গরীব-নাওয়ায আপন মুরীদগণ ও ভক্তবৃন্দের সাথে গযনী তাশরীফ নিয়ে যান। আর ক্বুত্ব্ব সাহেবকে অনুমতি দিলেন যেন তিনি আপন আম্মাজানের সাথে সাক্ষাতের জন্য- আউশ তাশরীফ নিয়ে যান। অতঃপর যখন হযরত খাজা গযনী থেকে হিন্দুস্তান ফিরে আসলেন, তখন ক্বুত্বব সাহেবও আউশ থেকে হিন্দুস্তানের জন্য রওনা হয়ে গেলেন।
মুলতানে হযরত বাবা ফরীদের সাথে সাক্ষাৎ
৫৯০ হিজরীতে হিন্দুস্তানে আসার সময় হযরত ক্বুত্বব সাহেব মূলতানে পৌঁছেন। মুলতান ওই সময় জ্ঞানচর্চার কেন্দ্রস্থল ছিলো। ঘটনাচক্রে শিক্ষার্জনের জন্য হযরত বাবা ফরীদ গঞ্জেশকরও তখন মুলতানেই ছিলেন। মুলতানে অবস্থান কালে হযরত ক্বুত্বব সাহেব একদিন ওই মসজিদে তাশরীফ নিয়ে গেলেন, যাতে বাবা সাহেব অবস্থান করছিলেন। বাবা সাহেব কিতাব পাঠ-পর্যালোচনায় মশগুল ছিলেন। যখনই হযরত বাবা সাহেবের দৃষ্টি হযরত ক্বুত্বব সাহেবের উপর পড়লো, তখনই তিনি কিতাব বন্ধ করে দাঁড়িয়ে গেলেন এবং সালাম- অভ্যর্থনার নিয়মাবলী যথাযথভাবে পালন করলেন।
হযরত ক্বুত্বব সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন- কী পড়ছো? জবাবে তিনি আরয করলেন, ‘কিতাব-ই নাফি’ পড়ছি।’’ হযরত বললেন, ‘কিতাব-ই নাফি’ থেকে কি তুমি কাক্সিক্ষত উপকার পাবে?’’ এটা শুনা মাত্র তিনি অতি বিনয়ের সাথে জবাব দিলেন, ‘‘আমার জন্য তো আপনি হযরতের কদম বুচিই উপকারী হবে।’’ এটা বলে তিনি আর নিজেকে সামলাতে পারেন নি, হযরত ক্বুত্বব সাহেবের কদমযুগলের উপর নিজের মাথা রেখে দিলেন। প্রথম দৃষ্টিতেই ক্বত্বব সাহেবের বাতেনী মনযোগ (তাওয়াজ্জুহ-ই বাতেনী) দ্বারা এমনভাবে সিক্ত হয়েছিলেন যে, তিনি তাঁর একান্ত-অনুরক্ত হয়েই গিয়েছিলেন। এখন থেকে তিনি রাতদিন হযরত ক্বুত্বব সাহেবের সান্নিধ্যে থাকতে লাগলেন।
হযরত বাবা সাহেব ইশ্ক্ব মা’রিফতের গলির দহলিযে
মুলতানে কিছু দিন অবস্থান করার পর হযরত ক্বুত্বব সাহেব দিল্লী রওনা হয়ে গেলেন। হযরত বাবা সাহেবও তাঁর সাথে দিল্লী চলে যেতে চাইলেন। তখন তিনি এরশাদ ফরমালেন-
‘‘তুমি এখানে শিক্ষার্জনে মশগুল থাকো।’’
কিন্তু কিছু দিন পর, শেষ পর্যন্ত তিনি ক্বুত্বব সাহেবের সাক্ষাতের জন্য একান্তভাবে আগ্রহী হয়ে ওঠেন এবং দিল্লী চলে যান। এখানে হযরত ক্বুত্বব সাহেবের খিদমতে আত্মনিয়োগ করেন। প্রথম মজলিসেই হযরত ক্বুত্বব সাহেব বাবা সাহেবকে বায়‘আত করিয়ে ধন্য করলেন। দিল্লীতে কিছুদিন অবস্থান করার পর হযরত ক্বুত্বব সাহেববের নির্দেশে বাবা সাহেব আরো বেশী জ্ঞান অর্জনের জন্য কান্দাহার রওনা হয়ে যান। ওখানে তিনি অতি পরিশ্রম করে যাহেরী ইল্ম অর্জন সমাপ্ত করলেন। এরপর ইরাক, খোরাসান, মা-ওয়ারাআন্ নাহ্র, হেরমাঈনে তাইয়্যেবাঈনের যিয়ারত করে ধন্য হলেন। তারপর আপন মুর্শিদে করীমের খিদমতে দিল্লীতে হাযির হয়ে গেলেন।
খাজা গরীব-নাওয়াযের শুভাগমন
ইত্যবসরে হযরত গরীব-নাওয়ায আজমীর শরীফ থেকে দিল্লী তাশরীফ আনয়ন করেন এবং ক্বুত্বব সাহেবের খানক্বায় অবস্থান করেন। সত্য সন্ধানীরা হযরত খাজার সান্নিধ্যে এসে এমনভাবে উপকৃত হয়েছেন যে, তাঁরা নিজ নিজ উদ্দেশ্য স্থলে পৌঁছে গেলেন। হযরত ক্বুত্বব সাহেব তাঁর মুরীদদেরকে হযরত খাজা গরীব-নাওয়াযের দরবারে পেশ করলেন। সবাইকে খাজা গরীব-নাওয়ায যোগ্যতানুসারে মা’রিফাতের অমূল্য সম্পদ দ্বারা ধন্য করলেন। যখন ফিরে যাবার সময় ঘনিয়ে এসেছিলো, তখন ইরশাদ করলেন, ‘‘তোমার মুরীদদের মধ্যে কেউ বাকী থাকলে তাকেও হাযির করো। তিনি আরয করলেন, ‘‘হযূর! ফরীদ নামের আপনার এক গোলাম চিল্লারত আছে।’’ হযরত খাজা বললেন, ‘‘চলো তাকে দেখে আসি- সে কি অবস্থায় আছে!’’
হযরত বাবা সাহেবের পূর্ণতা অর্জনের সময় ঘনিয়ে এসেছে
হযরত খাজা গরীব-নাওয়ায ও হযরত ক্বুত্বব সাহেব উভয় বুযুর্গ ওখানে তাশরীফ নিয়ে গেলেন। বাবা সাহেব চিল্লায় বসে সাধনারত ছিলেন। লাগাতার কঠোর রিয়াযতের কারণে তিনি এত বেশী দুর্বল হয়ে গিয়েছিলেন যে, সম্মান প্রদর্শনের জন্য দণ্ডায়মান হতে পারছিলেন না। সুতরাং তিনি কেঁদে কেঁদে খাজায়ে খাজেগানের পদযুগলের উপর নিজের মাথা রেখে দিলেন। খাজা গরীব-নাওয়ায তাঁর অবস্থা দেখে ইরশাদ করলেন-
‘‘ক্বুত্বব উদ্দীন! কতদিন পর্যন্ত এ বেচারাকে এমন কষ্টসাধ্য সাধনায় রত রাখবে? এসো তাকে কিছু দান করি।’’
এটা বলতে বলতে হযরত খাজা গরীব-নাওয়ায ডান ডানা আর হযরত ক্বুত্বব সাহেব বাম ডানা ধরে বাবা সাহেবকে দাঁড় করালেন। খাজা গরীব-নাওয়ায উপরের দিকে চেহারা তুলে আল্লাহ্ তা‘আলার দরবারে আরয করলেন-
‘‘হে অমুখাপেক্ষী মালিক! আমাদের ফরীদকে কবূল করুন! আর তাকে পূর্ণাঙ্গ দরবেশের মর্যাদায় আসীন করে দিন!’’
গায়বের পর্দা থেকে আওয়াজ আসলো, ‘‘আমি ফরীদকে কবূল করেছি। সে যুগের অনন্য (বুযুর্গ) হবে।’’
এরপর খাজা গরীব-নাওয়াযের নির্দেশে ক্বুত্বব সাহেব বাবা সাহেবকে ‘ইস্মে আ’যম’ শিক্ষা দিলেন, যা খাজেগানে চিশ্তের সিলসিলায় এক গোপন আমানত। ইস্মে আ’যম-এর বরকতে চোখের পলক মারার সাথে সাথে সমস্ত হিজাব (অন্তরাল) উঠে গেলো। আর তিনি আল্লাহর সান্নিধ্যে পৌঁছার নি’মাত পেয়ে ধন্য হলেন। এ খুশীতে হযরত খাজা গরীব-নাওয়ায বাবা সাহেবকে ‘অতি গর্বময় ‘খিল‘আত’ (চাদর বিশেষ) দান করে ধন্য করলেন। এরপর ক্বুত্বব সাহেব বাবা সাহেবকে পাগড়ি, শাল এবং খিলাফতের সনদ দান করলেন। হযরত খাজা গরীব-নাওয়ায ক্বুত্বব সাহেবকে মুবারকবাদ (ধন্যবাদ) দিয়ে এরশাদ করলেন-
‘‘তুমি এক বড় ঘোড়-সাওয়ার (অশ্বারোহী)-কে নিজের অধীনে নিয়ে এসেছো। তার কুঠির হবে সিদ্রাতুল মুন্তাহায়।’’
ক্বুত্বব সাহেবের আরেক দীর্ঘ সফর
এরপর ক্বুত্বব সাহেব আপন মহিয়সী আম্মাজানের সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য ‘আঊশ’-এ তাশরীফ নিয়ে যান। ফিরে আসার সময় হযরত জালাল উদ্দীন তাবরিযী তাঁর সফরসঙ্গী হয়ে গেলেন। তাঁরা পথিমধ্যে কিছুদিন মুলতানে অবস্থান করেন। এটা সুলতান শামসুদ্দীন ইলতুৎমিশের শাসনামল ছিলো। তখনকার সময়ে হযরত শায়খ বাহা উদ্দীন যাকারিয়া মুলতানীর বেলায়তের ডঙ্কা বাজছিলো। মুলতানের গভর্ণর ক্বোবাচাহ্ বেগ হযরত ক্বুত্বব সাহেবকে মুলতানে থেকে যাওয়ার জন্য আবেদন করলেন। হযরত অপরাগতা পেশ করে বললেন, ‘‘এ এলাকার হযরত বাহা উদ্দীন যাকারিয়ার বেলায়তের রাজ্য। এখানকার বাদশাহী তাঁরই প্রাপ্য।’’ কিছুদিন পর হযরত ক্বুত্বব সাহেব মুলতান থেকে দিল্লীর জন্য রওনা হয়ে গেলেন। কিছুলোক তাঁর হাতে বায়‘আত গ্রহণের জন্য বারংবার আবেদন করলেন। তিনি মুলতানের সীমানার বাইরে গিয়ে ‘হাসি’ নামক স্থানে তাদেরকে বায়‘আত করিয়ে ধন্য করলেন।
দিল্লীতে হযরত ক্বুত্বব সাহেবের স্থায়ীভাবে অবস্থান
৬১২ হিজরী মোতাবেক ১২১৪ খ্রিস্টাব্দে হযরত ক্বুত্বব সাহেব দিল্লীতে স্থায়ীভাবে অবস্থানের ইচ্ছা করলেন। সুতরাং তিনি কিলোকারীতে অবস্থান গ্রহণ করলেন। তখন দিল্লীর সিংহাসন মেহের ওয়ালীতে ছিলো। সুলতান শামসুদ্দীন ইলতুৎমিশের আবেদনের ভিত্তিতে তিনি কিছুদিন পর কিলোকারী থেকে মেহেরওয়ালী শরীফে স্থানান্তরিত হয়ে গেলেন। আর এক রুটি বিক্রেতার ঘরে অবস্থান গ্রহণ করেন। কিছুদিন পর ক্বাযী হামীদ উদ্দীন নাগূরী হযরতকে নিজের ঘরে নিয়ে গেলেন। তারপর ওখান থেকে ‘মসজিদে-ই ই’যায উদ্দীন’-এর নিকটে নিজের অবস্থান স্থানান্তরিত করে নেন।
শায়খুল ইসলাম পদে অধিষ্ঠিত হবার প্রস্তাব
তখনকার সময়ে সরকারের দিক থেকে ‘শায়খুল ইসলাম’-এর পদে হযরত জামাল উদ্দীন বোস্তামী অধিষ্ঠিত ছিলেন। যখন তাঁর ইন্তিকাল হয়ে গেলো, তখন সুলতান ইলতুৎমিশ হযরত ক্বুত্বব সাহেবের দরবারে আবেদন করলেন যেন তিনি এ মহান পদ ক্ববূল করে তাঁদেরকে গর্বিত করেন! যখন ক্বুত্বব সাহেব তা গ্রহণ করতে অস্বীকার করলেন, তখন নাজমুদ্দীন সুগরাকে ওই পদে অধিষ্ঠিত করেন।
খাজা গরীব-নাওয়াযের দিল্লীতে শুভাগমন
ইতোমধ্যে হযরত ক্বুত্বব সাহেব খাজা গরীব-নাওয়াযের পবিত্র দরবারে আজমীর শরীফে আগ্রহভরে এ আবেদনপত্র পাঠালেন যেন তাঁর পবিত্র দরবারে আসার অনুমতি দেন। খাজা গরীব-নাওয়ায তাঁকে আজমীর শরীফে যেতে নিষেধ করলেন। এবং কিছুদিন পর নিজেই দিল্লীতে তাশরীফ আনয়ন করলেন। এখানে এসে হযরত ক্বুত্বব সাহেবের খানক্বায় হযরত গরীব-নাওয়ায সদয় অবস্থান করলেন। তিনি যতদিন দিল্লীতে অবস্থান করলেন ততদিন সত্যান্বেষীদের মধ্যে ইরফানের ভাণ্ডার বিতরণ করতে থাকেন। কিছুদিন পর তিনি আজমীর শরীফে তাশরীফ নিয়ে গেলেন।
শেষবারের মতো খাজা গরীব নাওয়াযের দিল্লীতে শুভাগমন
এবার কোন ঘোষণা ছাড়াই গরীব-নাওয়ায হঠাৎ দিল্লী তাশরীফ নিয়ে আসেন। ওই সময় শায়খ নাজমুদ্দীন সুগরা দিল্লীতে ‘শায়খুল ইসলাম’-এর পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। খাজা গরীব নাওয়াযের সাথে তাঁর দীর্ঘ দিনের সম্পর্ক ছিলো। বন্ধুত্বের কারণে খাজা গরীব-নাওয়ায নিজেই তাঁর সাথে সাক্ষাতের জন্য তাশরীফ নিয়ে যান। তিনি খাজা গরীব-নাওয়াযকে অতি হৃদ্যতাপূর্ণ সংবর্ধনা দিয়েছেন। খাজা গরীব-নাওয়ায এর কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। তিনি বললেন, ‘‘আপনি আপনার এমন মুরীদকে দিল্লীতে বসিয়ে দিয়েছেন, সব মানুষ তাঁর দিকে দৌঁড়ে, আমার কথা কেউ জিজ্ঞাসাও করে না।’’ খাজা গরীব-নাওয়ায এরশাদ করলেন, ‘‘হে নাজমুদ্দীন! যদি আমার ক্বুত্বব তোমার অন্তরের বোঝা হয়ে যায়, তাহলে আমি তাকে আমার সাথে আজমীরে নিয়ে যাচ্ছি।’’
যখনই খাজা গরীব-নাওয়ায হযরত ক্বুত্বব সাহেবকে সাথে নিয়ে আজমীরের দিকে রওনা হলেন, তখন সমগ্র দিল্লী শহরে এ খবর বিজলীর মতো পৌঁছে গেলো। যে যেখানে ছিলো, ওখান থেকে দৌঁড়ে গেলো। শেষ পর্যন্ত খাজা গরীব-নাওয়াযের সামনে হাজার হাজার মানুষ ক্রন্দনরত অবস্থায় সমবেত হয়ে গেলো। আর বুকভাসা কান্নার স্বরে আরয করতে থাকে, ‘‘মেহেরবাণী করে ক্বুত্বব সাহেবকে দিল্লী থেকে নিয়ে যাবে না। ক্বুত্বব সাহেব এ শহরের সম্মান ও বরকত।’’ সুলতান ইলতুৎমিশ্ এ খবর পাওয়া মাত্র তাৎক্ষণিকভাবে হাযির হয়ে গেলেন। আর আরয করলেন, ‘‘হুযূর! ক্বুত্বব সাহেবকে আজমীরে নিয়ে যাবেন না। এখানেই তাঁকে রেখে যান! এ শহরের লোকেরা তাঁর বিচ্ছেদ বরদাশ্ত করতে পারবে না।’’ খাজা গরীব নাওয়ায যখন এ নক্শা দেখলেন, তখন তিনি হযরত ক্বুত্বব সাহেবের উদ্দেশে এরশাদ করলেন-
‘‘বাবা ক্বুত্বব, তুমি এখানেই থাকো! তোমার চলে যাবার কারণে শহরের লোকেরা অস্থির হয়ে গেছে। তাদের মনে দুঃখ দেওয়া আমারও সহ্য হচ্ছে না। এ শহরের সংরক্ষণ ও নিরাপত্তার দায়িত্ব তোমার হাতে দিলাম।’’
আপন মুর্শিদের নির্দেশের সামনে হযরত ক্বুত্বব সাহেব শির অবনত করে নিলেন। (অর্থাৎ তাঁর বরকতময় নির্দেশ মাথা পেতে নিলেন।) আর দিল্লীবাসীদের উপর তাঁর ফয়য ও বরকতের বৃষ্টি বর্ষণ করতে থাকেন।
চির বিদায়ের অসহনীয় বেদনাদায়ক খবর
এরপর আপন পীর-মুর্শিদের সশরীর সাক্ষাৎ দীর্ঘ দিন যাবৎ হয়নি। তাই হযরত ক্বুত্বব সাহেব আবার একটি চিঠি খাজা গরীব নাওয়াযের পবিত্র দরবার আজমীর শরীফে প্রেরণ করলেন। আর তাতে (সেখানে গিয়ে) কদমবুচির অনুমতি চাইলেন। জবাব আসলো, ‘‘আমি চাচ্ছিলাম যে, হে প্রিয় বৎস, তোমাকে ডেকে আনবো, ইত্যবসরে তোমার চিঠি এসে গেছে। তুমি শীঘ্রই চলে এসো! এ দুনিয়ায় তোমার সাথে আমার এটা সর্বশেষ সাক্ষাৎ।’’
হযরত ক্বুত্বব সাহেব এ চিঠি পড়া মাত্র কালবিলম্ব না করে আজমীর শরীফের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেলেন। আপন পীর ও মুর্শিদের দরবারে হাযির হলেন। কদমবুচির সৌভাগ্য অর্জন করলেন। একদিন খাজা গরীব নাওয়ায বললেন-
‘‘ওহে দরবেশ! আজমীর শরীফের ভূ-খণ্ডে আমাকে এ জন্য প্রেরণ করা হয়েছে যে, এখানেই আমার কবর হবে। আমার এমন অনুভব হচ্ছে যেন আমার পরকালে সফর করার সময় ঘনিয়ে এসেছে।’’
এটা বলতে বলতে খাজা গরীব-নাওয়াযের দু’নয়ন অশ্র“ সজল হয়ে গেলো। পূর্ণ মজলিসে কান্নার রোল পড়ে গেলো। আজমীর শরীফে অবস্থান কালে হযরত ক্বুত্বব সাহেব আপন পীরের আখেরী মজলিসের যেই রোয়েদাদ ফার্সী ভাষায় বর্ণনা করেছেন, সেটার বঙ্গানুবাদ নিন্মরূপ:
‘‘শায়খ আলী সানজারী হাযির ছিলেন। তাকে নির্দেশ দেওয়া হলো-এ বাণী লিপিবদ্ধ করা হোক! অতঃপর সেটা আমার ক্বুত্বব উদ্দীনের নিকট হস্তান্তর করা হোক, যাতে সে দিল্লী চলে যায়। আমি তাকে আমার সাজ্জাদানশীন করলাম এবং দিল্লীকে তাঁর চূড়ান্ত অবস্থানস্থল সাব্যস্ত করলাম।’’
যখন বাণী শরীফ লিপিবদ্ধ করা সমাপ্ত হলো, তখন সেটা হযরত ক্বুত্বব সাহেবকে দান করলেন। তিনিও আদব, সম্মান ও কৃতজ্ঞতার যাবতীয় নিয়ম পালন করলেন। অতঃপর খাজা গরীব-নাওয়ায বললেন, ‘‘ক্বুত্বব, আমার নিকটে এসো।’’ হযরত ক্বুত্বব বলেন, ‘‘আমি হযরতের নিকটে গেলাম। তিনি নিজ বরকতময় হাতে টুপি সহকারে পাগড়ি আমার মাথায় পরিয়ে দিলেন। হযরত ওসমান হারূনী রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হির লাঠি ও খিরকাহ্ মুবারক আমাকে দান করলেন এবং ক্বোরআন-ই করীম আর মুসল্লাও দান করলেন।’’
তারপর এরশাদ করলেন, ‘‘এটা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র আমানত, যা খাজেগাানে চিশ্তের মাধ্যমে আমার নিকট পর্যন্ত পৌঁছেছে। এসব আমানত আমি তোমাকে সোপর্দ করছ্ িতোমার উপর অপরিহার্য হচ্ছে- আমি যেভাবে এসব জিনিসকে নিজের নিকট সংরক্ষণ করেছি, তেমনিভাবে তুমিও নিজের নিকট সংরক্ষণ করবে, যাতে কাল কিয়ামতে খাজেগানে চিশ্তের সামনে লজ্জিত হতে না হয়। বিদায়ের মুহূর্তে এরশাদ করলেন-
‘‘যাও! আমি তোমাকে আল্লাহর রাস্তায় সোপর্দ করলাম। আর তোমাকে ইয্যাত ও বুযুর্গীর আসনে অধিষ্ঠিত করলাম।’’
ক্বুত্বব সাহেব বলেন, ‘‘এ নি’মাতের কৃতজ্ঞতায় আমি দু’রাক‘আত নামায পড়েছি এবং অতি আদব সহকারে তা গ্রহণ করেছি।’’
আজমীর শরীফ থেকে ফিরে এলেন
বুকভরা দুঃখ নিয়ে হযরত ক্বুত্বব সাহেব দিল্লীর উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। দিল্লী পৌঁছার পর তিনি সব সময় এ দুশ্চিন্তায় অস্থির থাকতেন আর অপেক্ষায় থাকতেন যে কখন আজমীর শরীফ থেকে হৃদয় কম্পনকারী সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত বিশদিন পর একদিন আজমীর শরীফ থেকে খবর এসে গেলো। বিনা মেঘে বজ্রপাত হলো। হৃদয়পটের সবুজ তৃণগুলো জ্বলছিলো। শোকের প্রচণ্ডতার কারণে তিনি মুসল্লার উপর নামায পড়ে শুয়ে গেলেন। স্বপ্নে আপন পীর মুর্শিদকে দেখেছেন- তিনি অতি খুশী ও আনন্দিত আছেন। আর দিকনির্দেশক বাণী এরশাদ করছেন। হযরত ক্বুতব চক্ষুযুগল খুললেন। তখন হৃদয়ে এ ঘটনা কল্পনা করে শান্ত্বনা পেলেন এজন্য যে, ওফাত শরীফের পরও আপন পীর-মুর্শিদের কৃপাদৃষ্টি আপন মুরীদ ও ভক্তবৃন্দের প্রতি নিবদ্ধ রয়েছে।
পীর-মুর্শিদ আরশবাসীদের সাথে
খোদাওয়ান্দ-ই করীম তাঁকে আপন খাস রহমত দ্বারা ধন্য করেছেন। আর ফেরেশতাগণ ও আরশের অধিবাসীদের নিকটে স্থান দিয়েছেন। আর বললেন, আমি এখন এখানেই থাকি।
স্ত্রী ও সন্তানগণ
তিনি দু’টি শাদী করেছেন: প্রথম শাদী তাঁর জন্মস্থানে সম্পন্ন হয়েছিলো, যার সমস্ত ব্যবস্থাপনা তাঁর আম্মাজানই করেছিলেন। তিনদিন পর তিনি স্ত্রীকে পৃথক করে দিলেন। কেননা, তাঁর দৈনন্দিন রুটিন ছিলো যে, তিনি প্রত্যেক দিন শয়নের সময় তিন হাজার বার দুরূদ শরীফের ওযীফা পড়তেন। শাদীর কারণে তিনদিন দুরূদ শরীফ পড়তে পারেননি। স্বপ্নে হুযূর-ই আকরাম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এক বুযুর্গকে এরশাদ ফরমালেন, ‘‘ক্বুত্বব উদ্দীন আউলিয়াকে আমার সালাম বলিও। তাকে আমার পক্ষ থেকে বলিও, ‘‘কি ব্যাপার! যে তোহফা সে প্রত্যেক রাতে আমার নিকট পৌঁছাতো আজ তিন রাত যাবৎ পাঠায়নি।’’
হুযূর-ই আকরামের এ পয়গাম শুনে ক্বুত্বব সাহেব বিবিকে পৃথক করে দিলেন যাতে কখনো এ দুর্ঘটনা আর না ঘটে যায়।
আর দ্বিতীয় বিবাহ্ শেষ বয়সে করেছেন, যখন তিনি দিল্লীতে বসবাস করছিলেন। এ স্ত্রীর গর্ভে তাঁর দু’সাহেবযাদা জন্মগ্রহণ করেন। প্রথম সাহেবযাদার নাম মুহাম্মদ আর দ্বিতীয় সাহেবযাদার নাম শায়খ আহমদ ছিলো।
জীবদ্দশায় নিজের দাফনের স্থান নির্বাচন ও সেটার ফযীলত
কোন এক ঈদের দিনে ঈদগাহ্ থেকে ফিরে আসার সময় হযরত ক্বুত্বব সাহেব রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি একটি পরিত্যক্ত (খালি) জমিতে তাশরীফ আনলেন। আর এরশাদ করলেন, ‘‘এ জমি থেকে আমি পবিত্র অন্তর সমূহের খুশবু পাচ্ছি। এ জমির মালিককে হাযির করো। মালিক হাযির হলো। তিনি তার নিকট থেকে ওই জমি খরিদ করলেন। আর বললেন, ‘‘এখানেই আমার দাফনের জায়গা হবে।’’ এটা হচ্ছে ওই জমি, যেখানে বর্তমানে হযরত ক্বুত্বব সাহেবের মাযার মুবারক রয়েছে। এ ভূ-খণ্ড সম্পর্কে কাশ্ফ ও রূহানী শক্তি সম্পন্ন বুযুর্গরা দেখেছেন যে, ওখানে আরশ থেকে ফরশ পর্যন্ত নূরই নূর বিরাজ করছে।
পরকালের দিকে সফর
একদিন শায়খ আলী সানজারীর খানক্বাহ্ শরীফে গযলের মাহফিল হচ্ছিলো। সেখানে ‘হাল’ ও ‘কামাল’-এর ধারক দরবেশদের সমাবেশ ছিলো। গযলখাঁগণ হযরত আহমদ জামের একটি গযল পড়া আরম্ভ করলেন। গযল খাঁ নিন্মলিখিত শে’র (পংক্তি) পড়লেন-
كشتانি خنجر تسليم را- هر زماں از غيب جانے ديرা است
অর্থ: মেনে নেয়ার খঞ্জর দ্বারা যাদেরকে শহীদ করা হয়েছে, প্রতিটি যুগে গায়ব থেকে তাদের জন্য অন্য একটি প্রাণ (অবস্থা) আসে।
এটা শুনে হযরত ক্বুত্বব সাহেবের মধ্যে এমন ওয়াজদ (মুর্চ্ছনা) এসে গেলো যে, ওই অবস্থায় তিনি বে-হুঁশ হয়ে গেলেন। ক্বাযী হামীদ উদ্দীন নাগূরী ও শায়খ বদর উদ্দীন গযনভী তাঁকে ওই অবস্থায় ঘরে নিয়ে আসলেন। গযলখাঁগণও সাথে এলেন। গযল খানি চলতে থাকে। যখনই তাঁর হুঁশ আসতো, তখন তিনি ওই পংক্তিটি পুনরায় পড়ার জন্য নির্দেশ দিচ্ছিলেন। এটা শুনে পুনরায় তাঁর মধ্যে ওয়াজদ এস যেতো। চারদিন যাবৎ তাঁর এ অবস্থা রইলো। তিনি বে-হুঁশ ছিলেন। কিন্তু নামাযের সময় তাঁর হুঁশ এসে যেতো। যখন তিনি নামায পড়ে নিতেন, তখন আবার ওই অবস্থা হয়ে যেতো। তৃতীয় দিনে তাঁর দেহের চুল ও লোমগুলো থেকে ‘ইসমে যাত’-এর তাসবীহর আওয়াজ আসতে লাগলো। প্রত্যেক লোমের গোড়া থেকে রক্তের ফোঁটা ঝড়তে লাগলো। যে ফোঁটা মাটিতে পড়তো, তা থেকে الله (আল্লাহ্) শব্দের নকশা তৈরি হয়ে যেতো। গযল খাঁ যখন ওই চরণের প্রথমাংশ পড়তেন, তখন হযরত ক্বুত্বব সাহেবের দেহ শরীফ থেকে রূহ মুবারক অদৃশ্য হয় যেতো আর যখন দ্বিতীয় অংশ পড়তেন, তখন রূহ ফিরে আসতো।
১০ রবিউল আউয়াল ৬৩৩ হিজরীতে তাঁর এ অবস্থা হলো চার দিন ও রাত এ অবস্থা রইলো। পঞ্চম রাতে যখন এ পঙক্তিটার প্রথমাংশ বারংবার পড়া হচ্ছিলো, তখন তাঁর রূহ মুবারক তাঁর দেহ মুবারক থেকে বের হয়ে গেলো। তাঁর ওফাত শরীফের খবর শুনে দিল্লীতে শোকের ছায়া নেমে আসলো। কান্নার রোল পড়ে গেলো। চতুর্দিকে যেন দ্বিতীয় ক্বিয়ামত অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো।
জানাযার নামায ও তাঁর ওসীয়ৎ
লাখো লোকের ভিড় চিরে যখন জানাযা মুবারক এনে ময়দানে রাখা হলো, তখন হযরত মাওলানা আবূ সা‘ঈদ সাহেব জানাযার নামাযের ইমামত সম্পর্কে হযরত ক্বুত্বব সাহেবের ওসীয়ৎ ঘোষণা করলেন। তিনি বলেন, আমাদের খাজা ওসীয়ৎ করেছেন- ‘‘আমার জানাযার নামায যেন ওই ব্যক্তি পড়ান, যিনি কখনো হারাম কাজ করেন নি, যাঁর আসরের সুন্নাত ও ফরযের তাকবীর-ই উলা কখনো ছুটে যায়নি।’’ যখন উপস্থিত লোকদেরকে এ ওসীয়ৎ শোনানো হলো, তখন প্রত্যেকে হতভম্ভ হয়ে গেলো। এ ভেবে যে, শেষ পর্যন্ত ওই ব্যক্তি কে, যিনি হযরতের জানাযার নামাযের ইমামতি করার উপযোগী? এবং এ তিন শর্ত কার মধ্যে মওজুদ? অনেক্ষণ পর্যন্ত ওই বিশাল সমাবেশে নিরবতা বিরাজ করছিলো। যখন কেউ আগে বাড়তে পারলো না, তখন উচ্চ স্বরে ঘোষণা দিয়ে সুলতান শামসুদ্দীন ইলতুৎমিশ এগিয়ে গেলেন। আর আবেগাপ্লুত কন্ঠে বললেন-
‘‘আমি চাচ্ছিলামনা আমার অবস্থা মানুষের সামনে প্রকাশ পাক, কিন্তু আফ্সোস! আজ ক্বুত্ববুল আক্বত্বাবের ওসীয়ৎ আমার জীবনের এক গোপন রহস্যকে ফাঁশ করে দিলো।’’
শেষ পর্যন্ত সুলতান ইলতুৎমিশের ইমামতিতে লাখো মুসলমান জানাযায় ফরয নামায সম্পন্ন করলেন। তাঁর জানাযার এত বেশী ভিড় ছিলো যে, তাঁর কফীন শরীফ পর্যন্ত পৌঁছানো অতি কঠিন ব্যাপার ছিলো। অনেকে তো তাঁর কফীন শরীফ দেখতেও পায়নি। তাঁকে ওই স্থানে দাফন করা হলো, যাকে তিনি নিজেই সর্বশেষ বিশ্রামস্থল হিসেবে নির্বাচন করে গিয়েছিলেন।
তাঁর মাযার শরীফে রাতদিন অগণিত মানুষ যিয়ারত করেন। আজও ফয়য-বরকতের ফোয়ারা তেমনিভাবে জারী রয়েছে, যেভাবে তাঁর বরকতময় জীবদ্দশায় জারী হতো। প্রতি বছর তাঁর ওরস মুবারক ১৩ ও ১৪ রবিউল আউয়াল শরীফ দরগাহ্ শরীফে, মেহের ওলী, নয়াদিল্লীতে অনুষ্ঠিত হয়। অতি ভাবগম্ভীর্যের সাথে যথানিয়মে এ ওরস শরীফের আয়োজন করা হয়।
সুন্দর চরিত্র ও অভ্যাস
আল্লাহর ইবাদত ও যিকর: তিনি ইবাদত করার সময় তাঁর বিশেষ কাইফিয়াত বা অবস্থার সৃষ্টি হতো। তিনি পবিত্র ক্বোরআনের হাফেয ছিলেন। পাঁচ ওয়াক্তের ফরয নামাযগুলো সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে তিনি অত্যন্ত যতœবান ও সচেষ্ট ছিলেন। প্রতিদিন তিনশ’ রাক‘আত নফল নামায সম্পন্ন করতেন। রাতে শয়নের সময় তিন হাজার বার দুরূদ শরীফের ওযীফা অবশ্যই আদায় করতেন।
নির্জনে অবস্থান
কম কথা বলা, কম শয়ন করা ও কম খাওয়া তাঁর বৈশিষ্ট্য ছিলো। মহান স্রষ্টার সাথে মশগুল ও সৃষ্টি থেকে দূরে থাকতে তিনি অভ্যস্থ ছিলেন। তিনি সব সময় নিশ্চুপ ও চিন্তামগ্ন থাকতেন। অনেক সময় কাটাতেন কান্নাকাটিতে। ঘরের দরজা বন্ধ করে একাকী বসে থাকতেন।
রাত্রি জাগরণ
প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি রাতে বেশীক্ষণ ঘুমাতেন এবং আরাম করতেন। কিন্তু শেষ বয়সে তিনি রাতের আরাম ও শয়ন করা (ঘুমানো) একেবারেই বর্জন করেছিলেন বলা যায়। গোটা রাত তিনি নামায, ক্বোরআন তিলাওয়াত এবং যিকরে খাফী ও জ্বলীতে মশগুল থাকতেন।
দারিদ্র ও উপবাস
অভাব-অনটন ও আর্থিক সংকটে থাকাকে তিনি বেশী পছন্দ করতেন। তাঁর ঘরে বেশীর ভাগ সময়ে অনাহার যাপন করা হতো, কিন্তু তাঁরা তা কারো নিকট প্রকাশ পেতে দিতেন না। সব অবস্থায় তাঁরা ধৈর্যশীল ও কৃতজ্ঞ থাকতেন। রিক্তহস্ততার এমন অবস্থা ছিলো যে, প্রাথমিক পর্যায়ে তাঁর ঘরে দস্তরখানা, রেকাবী ও থালা-পাত্রও ছিলো না।
নযরানা নিতে অস্বীকৃতি
তিনি কারো নিকট থেকে নযরানা গ্রহণ করতেন না। বাদশাহ্ ও ধনীরা আশরাফী (স্বর্ণমূদ্রা) থালা ভর্তি করে তাঁর দরবারে নিয়ে যেতেন। কিন্তু তিনি এ বলে পরিস্কার ভাষায় তা গ্রহণ করতে অস্বীকার করে দিতেন যে, এটা আমাদের বুযুর্গদের ত্বরীকার বরখেলাফ। যদি আমরা তাঁদের পদাঙ্ক থেকে সরে যাই, তবে কাল কিয়ামতে কিভাবে তাঁদেরকে মুখ দেখাবো?
আল্লাহর ধ্যানে মগ্নতা ও নিজেকে হারিয়ে ফেলার দীর্ঘ অবস্থা
তিনি সব সময় আল্লাহর ধ্যান মগ্ন থাকতেন এবং নিজেকে হারিয়ে ফেলতেন। তাঁর এ অবস্থা স্বাভাবিক অবস্থায় আসার জন্য অপেক্ষা করতে হতো। সব সময় মোরাক্বাবার অবস্থায় থাকতেন। নামাযের সময় চোখ খুলতেন, গোসল করতেন, তাজা ওযূ করতেন। আর নামায পড়তেন।
নিজের অবস্থা গোপন রাখতেন
হযরত ক্বুত্বব সাহেব নিজে যেসব ইবাদত, রিয়াযত করতেন তা কারো নিকট প্রকাশ পাওয়া পছন্দ করতেন না। তিনি তাঁর মুরীদদেরকেও শিক্ষা দিতেন যেন খ্যাতি অর্জন ও নিজেকে যাহির করা থেকে বিরতে থাকেন। তিনি বলতেন- ‘‘জন সাধারণের দৃষ্টি থেকে গোপন থাকার মধ্যেই নিরাপত্তা রয়েছে। অখ্যাতিতে খায়র ও বরকত রয়েছে। আর খ্যাতি ও প্রসিদ্ধি পরীক্ষা ও বিপদের কারণ।’’
শিক্ষাপূর্ণ বাণীসমূহ
- যে ব্যক্তি আল্লাহর ভালোবাসার দাবী করে এবং কষ্টের সময় ফরিয়াদ করে সে ভালোবাসার দাবীতে সত্যবাদী নয়, বরং মিথ্যাবাদী ও অসত্যের প্রলাপকারী।
- যে দরবেশ দুনিয়াকে দেখানোর জন্য ভাল ও উন্নতমানের পোষাক পরে সে দরবেশ নয়, বরং সুলূকের পথে রাহাজানিকারী (ডাকাত)।
- যে দরবেশ নিজের প্রবৃত্তির চাহিদানুসারে পেটভর্তি করে আহার করে, সে প্রবৃত্তির পূজারী, দরবেশ নয়। দরবেশী আরামের নাম নয়, বরং কন্টকপূর্ণ পথ অতিক্রম করার নাম। দরবেশীর মধ্যে সর্বপেক্ষা কষ্টসাধ্য কাজ হচ্ছে- রাতে অনাহারে থাকা ও বিনিদ্র রাত যাপন করা।
- শরীরের মধ্যে এতটুকু রূহানী শক্তি থাকা জরুরী যে, তিনি মুরীদের ক্বলবের কালো দাগ আপন বাত্বেনী শক্তি দ্বারা পরিস্কার করবেন এবং তাকে আল্লাহ্ তা‘আলা পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দেবেন।
- মুরীদেরও পীরের সামনে ও অবর্তমানে এক সমান থাকা চাই। যখন পীরের ওফাত হয়ে যায়, তখন তাঁর সামনে আরো বেশী আদব প্রদর্শনকারী হয়ে যাওয়া চাই।
- দরবেশ ওই সময় পর্যন্ত নৈকট্যের স্থানে পৌঁছতে পারেন না, যতক্ষণ তিনি সব পর থেকে পর হয়ে না যান এবং দুনিয়ার আরাম আয়েশ থেকে নিজের বাতিনকে পরিষ্কার করে না নেন।
- রাবে‘আহ্ বসরী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহার অভ্যাস ছিলো যে, যেদিন তিনি কোন কষ্টে পড়তেন, সেদিন তাঁকে খুশী ও আনন্দিত দেখা যেতো। আর তিনি বলতেন, বন্ধুর কৃপাদৃষ্টি আমার দিকে নিবদ্ধ হয়েছে।
- চারটি বিষয় দরবেশের জন্য জরুরী: ১. এমন দারিদ্র, যার মধ্যে ধনী হওয়া প্রকাশ পায়, ২. ক্ষুধার্তদের পেট ভরানো, ৩. দুঃখের সময় খুশী প্রকাশ করা এবং ৪. শত্র“র সাথে বন্ধুত্ব করা।
আল্লাহ্ তা‘আলা আমাদেরকে আমাদের মুর্শিদ-ই করীম, আউলিয়া-ই কেরাম, বিশেষত হযরত ক্বুত্বব উদ্দীন বখতিয়ার কাকী আলায়হির রাহমার ফুয়ূয ও বরকাত এবং আদর্শের অনুসরণের তাওফীক দান করুন। আ-মী-ন