সুন্নীয়তের আপোষহীন সিপাহসালাসুন্নীয়তের আপোষহীন সিপাহসালার: শেরে বাংলা (The uncompromising Sipahsalar of Sunni: Sher-e-Bangla Allama Ghazi Syed Muhammad Azizul Haq Al-Qaderi)

The uncompromising Sipahsalar of Sunni: Sher-e-Bangla Allama Ghazi Syed Muhammad Azizul Haq Al-Qaderi
Join Telegram for More Books
Table of Contents

সুন্নীয়তের আপোষহীন সিপাহসালার:

শেরে বাংলা আল্লামা গাযী সৈয়দ মুহাম্মদ আযীযুল হক আল-ক্বাদেরী

কোন আদর্শ এবং ওই আদর্শের অনুসারী জনগোষ্ঠীর যখন ক্রান্তিকাল অতিবাহিত হয়, যুগোপযোগী ও যথাযথ উদ্যোগের অভাবে যখন ওই আদর্শ ও আদর্শের অনুসারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, বিরুদ্ধবাদী চক্র যখন তৎপর হয়ে নিজেদের অবস্থান গড়ে নেয় এবং ওই আদর্শের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সেটাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে সমাজে আদর্শ বিরোধী মতবাদ প্রচার ও প্রতিষ্ঠার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়, তখন ওই আদর্শের কোন প্রকৃত কর্ণধার নির্বিকার হয়ে বসে থাকতে পারেন না। তখন তিনি ওই সব প্রতিকূলতা ও আশঙ্কার সফল মোকাবেলার জন্য অস্থির হয়ে ওঠেন, পালন করেন অতন্ত্র ও আপোষহীন সিপাহসালারের ভূমিকা। এদেশে সুন্নীয়তের ইতিহাসে ইমামে আহলে সুন্নাত আল্লামা গাযী শেরে বাংলা রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হিও এমনি একজন প্রকৃত কর্ণধার (ইমাম) ছিলেন। সুন্নীয়তের ক্রান্তিকালে তিনিও সুন্নীয়তের প্রতি তাঁর অকৃত্রিম আন্তরিকতা ও অসাধারণ ত্যাগের চির অম্লান উদাহরণ প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। আদর্শের সৈনিকরা আজো তাঁর আদর্শ জীবন থেকে সত্য প্রতিষ্ঠার ও বাতিলের মোকাবেলার অনুপ্রেরণা লাভ করছে। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর মধ্যে বংশীয় গৌরব, জ্ঞান-গভীরতা, আত্ম বিশ্বাস ও অসাধারণ সৎসাহস থেকে আরম্ভ করে একাধারে বহুগুণ ও বৈশিষ্ট্য দান করেছিলেন।

বিগত ১৩২৩ হিজরী/১৯০৬ ইংরেজীর একটি বিশেষ দিনের এক শুভ মুহুর্তে চট্টগ্রাম জিলার হাটহাজারী থানার মেখল গ্রামে সম্ভ্রান্ত ‘সাইয়্যেদ’পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন আর ১৩৮৯ হিজরী/ ১৯৬৯ ইংরেজীতে ওফাত বরণ করেন। তাঁর পিতা হযরত সাইয়্যেদ আবদুল হামীদ আল-ক্বাদেরী এবং দাদা হযরত সাইয়্যেদ মুহাম্মদ হাশমত উল্লাহও ছিলেন যুগখ্যাত আলিম-ই দ্বীন ও বুযুর্গ ব্যক্তিত্ব। তাঁর আম্মাজান সাইয়্যেদা মায়মুনা খাতুনও ছিলেন বিদূষী, পুণ্যবতী ও রতœগর্ভা। পিতা ও মাতা উভয়ের দিক দিয়ে তিনি ছিলেন খাঁটি আওলাদে রসূল। হযরত আজিজুল হক আল্-ক্বাদেরী ছিলেন অসাধারণ মেধাশক্তি ও উন্নত চরিত্রের অধিকারী। তিনি স্থানীয় মাদ্রাসাগুলো থেকে নিয়মিতভাবে অধ্যয়ন করে টাইটেল পাশ করার পর ভারতের (তদানীন্তনকালীন হিন্দুস্তান) প্রসিদ্ধ ফতেহপুর মাদরাসা থেকে হাদীস ও ফিক্বহ ইত্যাদি শাস্ত্রে উচ্চতর শিক্ষা লাভ করেও ধন্য হন। পুঁথিগত ও অধ্যয়নগত শিক্ষায় তিনি ছিলেন এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী আলিম-ই দ্বীন। ভারতে অধ্যয়নকালে তিনি দেওবন্দ মাদরাসার শিক্ষা ব্যবস্থা ও শিক্ষকমণ্ডলীর জ্ঞানের গভীরতা যাচাই করার জন্য সেখানে যান। বাংলাদেশসহ এতদঞ্চলে সংক্রমিত ওহাবিয়াতের সুতিকাগার এ দেওবন্দ মাদরাসার অবস্থান যাচাই করা ভবিষ্যতে তাঁর কর্মময় জীবনের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। কারণ এতদ্ঞ্চলের মুসলিম সমাজ থেকে ইসলামী আলখেল্লা পরিহিত, আল্লাহ ও রসূলের দুশমনদের উৎখাত কিংবা চিহ্নিত করে সুন্নিয়াতের পতাকাকে উড্ডীন করতে তিনি ছিলেন দৃঢ়প্রত্যয়ী। তিনি প্রথমে ছাত্র বেশে দেওবন্দ মাদরাসায় গিয়ে মুহাদ্দিস আশফাকুর রহমান সহ তাদের অন্যান্য শীর্ষস্থানীয় শিক্ষকদের মুখোমুখি হন-তিনি তাদের সব প্রশ্নের যথাযথ জবাব দেন। অতঃপর তাদের অনুমতি নিয়ে তিনিও কয়েকটা প্রশ্ন করেন। কিন্তু তারা তাঁর একটি প্রশ্ন ব্যতীত বাকী প্রশ্নগুলোর জবাব দিতে ব্যর্থ হন, যেমনিভাবে তারা ইতোপূর্বে ইমামে আহলে সুন্নাত আ’লা হযরতের কোন বক্তব্য ও লেখনীর জবাব দিতে অক্ষম ছিলেন।  সুতরাং তিনি ওই দিনই বলে এসেছিলেন, ‘‘আমি তোমাদের থেকে শিক্ষা গ্রহণ নয়, বরং তোমাদেরকে শিক্ষা দেওয়ারই উপযোগী।’ তিনি তা-ই করেছিলেন- জীবনের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত। ওহাবী-দেওবন্দীসহ সমসাময়িক সব ধরনের বাতিলের আপোষহীন সফল মোকাবেলা করেছিলেন তিনি।

তাঁকে প্রধানত জ্ঞানাস্ত্র দ্বারাই সত্য প্রতিষ্ঠা ও সব ধরনের বাতিলের মোকাবেলা করতে হবে বিধায় আল্লাহ তাঁকে ইলমে লাদুন্নী দ্বারাও সমৃদ্ধ করেছিলেন। এক শুভ মুহুর্তে তিনি হযরত খাদ্বির আলায়হিস্ সালাম-এরও সাক্ষাৎ পেয়ে যান। হযরত খাদ্বির আলায়হিস্ সালাম আল্লামা গাযী শেরে বাংলার সাথে স্নেহের আলিঙ্গন করেন এবং পবিত্র হাদীস শরীফ থেকে চারটি সবক পড়িয়ে অদৃশ্য হয়ে যান। এর মাধ্যমে তাঁর মধ্যে ইল্মে লাদুন্নীও স্থান পায়। তদুপরি তাঁর ধমনীতে ছিলো- নবী পাক সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর পবিত্র বংশের রক্ত, হৃদয়ে ছিলো অকৃত্রিম খোদা ও রসূলপ্রেম। অধিকন্তু তাঁর মধ্যে ছিলো অসাধারণ ও নির্ভুল জ্ঞানানুসারে আমল করার অদম্য স্পৃহা। আরো ছিলো রূহানী শক্তি। সর্বোপরি, কুদরতিভাবে, তাঁর মধ্যে তেমনি খোদাপ্রেম ও ইশক্বে রসূল স্থান পেয়েছিলো যে, আল্লাহ্-রসূলের শানমান রক্ষার জন্য তিনি সত্যিকার অর্থে সব সময় অতন্ত্র-সচেষ্ট ও অকুতোভয় ছিলেন। এর ফলে, তিনি তজ্জন্য নিজের জীবনের সবকিছু, এমনকি নিজের প্রাণটুকু পর্যন্ত উৎসর্গ করতে দ্বিধাবোধ করেন নি।

ভারত থেকে তিনি দেশে ফিরে দ্বীন ও মাযহাবের খিদমতে আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর কর্ম জীবনে দেখা যায় যে, রসূলে পাকের সুন্নাত পালনের জন্য তিনি বিবাহ-শাদী করেছেন সত্য, কিন্তু যাবতীয় যোগ্যতাকে পূঁজি করে পার্থিব জীবনকে বর্ণাঢ্য করার দিকে কোন আগ্রহই ছিলো না তাঁর। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি একথাই প্রমাণ করেছেন- ‘‘মাইতো বীমারে নবী হোঁ!’’ (আমি নবীপ্রেমের অনন্য রোগেই ভুগছি।) সুতরাং স্বদেশে এসে তিনি ইসলামের প্রকৃত আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় সব কিছু করেছেন। যেমন-

প্রথমতঃ আল্লামা গাযী শেরে বাংলা রাহমাতুল্লাহি আলায়হি তাঁর কর্মজীবনের প্রাথমিক পর্যায় থেকে দ্বীন ও মাযহাবের প্রকৃত শিক্ষার প্রসারের দিকে মনযোগ দিলেন। তিনি ১৯৩২ ইংরেজীতে নিজ গ্রাম মেখলের ফকিরহাটে ‘এমদাদুল উলূম আজিজিয়া সুন্নিয়া মাদরাসা’ প্রতিষ্ঠা করে নিজেও শিক্ষকতা আরম্ভ করেন এবং তাঁর সঙ্গে দক্ষ সুন্নী-ওলামাকেও দ্বীনী শিক্ষার প্রসারে উদ্ধুদ্ধ করেন। তাছাড়া, ‘হাটহাজারী, জামেয়া আজিজিয়া অদূদিয়া সুন্নিয়া বর্তমানে, ‘অদুদিয়া সুন্নিয়া’, রাউজান ফতেহনগর অদুদিয়া সুন্নিয়া’, রাঙ্গুনিয়ার ‘চন্দ্রঘোনা অদুদিয়া সুন্নিয়া’ (বর্তমানে চন্দ্রঘোনা তৈয়্যবিয়া অদুদিয়া সুন্নিয়া মাদরাসা) এবং লালিয়ারহাট হামিদিয়া হোসাইনিয়া রাজ্জাকিয়া মাদরাসার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতার ভূমিকা পালন করেন। তাছাড়া,জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া, চট্টগ্রাম এবং সোবহানিয়া আলিয়া মাদরাসা, চট্টগ্রাম’র মতো শীর্ষস্থানীয় দ্বীনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর তিনি একান্ত শুভাকাক্সক্ষী ছিলেন। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেখানেই যারা সুন্নী মাদরাসা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছেন, সেখানে তাদের প্রায় সবারই প্রতি তিনি যথেষ্ট আন্তরিকতা প্রদর্শন করেছেন। তাঁর প্রসিদ্ধ লেখনী ‘দেওয়ানী-ই আযীয’-এ প্রসঙ্গে যথেষ্ট বিবরণ পাওয়া যায়।

দ্বিতীয়ত:ওয়ায-নসীহতঃ বলাবাহুল্য তখনো সরলপ্রাণ সাধারণ মুসলমানগণের বিশেষ করে দ্বীনী শিক্ষার আলো পাবার অন্যতম প্রধান উপায় ছিলো ওলামায়ে কেরামের শিক্ষাদান ও ওয়ায-নসীহত। আল্লামা গাযী শেরে বাংলার ওয়াযের প্রভাব ছিলো অকল্পনীয়। তাঁর নির্ভীক বর্ণনাভঙ্গি, আকর্ষণীয় কণ্ঠ ও হৃদয়গ্রাহী যুক্তি-প্রমাণ শ্রোতাদের মনে অকল্পনীয়ভাবে রেখা পাত করতো। তিনি যেদিকেই যেতেন জ্ঞান-পিপাসু ঢল নামতো। তিনিও ওয়ায-নসীহতের প্রতি অতি আন্তরিকতা প্রদর্শন করতেন। উদ্যোগীদের আহ্বানে দ্বীনী প্রয়োজনে দ্বীনের আলো বিকিরণের জন্য চলে যেতেন দূর-দূরান্তরে। তাঁর ওয়ায মাহফিলগুলোও ছিলো ওলামা-সাধারণের জন্য একেকটা নির্ভুল শিক্ষাক্ষেত্র। কারণ, তাঁর যুক্তি-প্রমাণগুলো ছিলো তাঁর বিরল ও সূক্ষ্ম তত্ত্ব ও তথ্য ভান্ডারের নির্যাস। ওইগুলো সাধারণ মানুষকে করতো তৃপ্ত আর ওলামা ও জ্ঞানী সমাজকে করতো আরো জ্ঞানসমৃদ্ধ।

তৃতীয়ত:তর্কযুদ্ধঃ যেসব এলাকায় ওহাবী-দেওবন্দীগণ, জামাতি, কাদিয়ানী ও শিয়া ইত্যাদি তাদের অবস্থান গড়ার জন্য তৎপর ছিলো সেসব এলাকার দ্বীনের জ্ঞান-সমৃদ্ধ আল্লামা গাযী শেরে বাংলা ও নির্দ্বিধায় ওহাবীসহ যাবতীয় বাতিলপন্থীকে তর্ক-মুনাযারার দিকে আহবান করতেন। এভাবে জনসাধারণের চাপের মুখে কিংবা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ওহাবী ও ক্বাদিয়ানী মতবাদীরা তর্কযুদ্ধে অবতীর্ণ হতো। আল্লামা গাযী শেরে বাংলাই বেশীরভাগ তর্কযুদ্ধে সুন্নীদের পক্ষে অংশগ্রহণ করতেন। চট্টগ্রাম এবং চট্টগ্রামের বাইরে গিয়েও তিনি বিশাল বিশাল মুনাযারা সভায় নির্ভীকচিত্তে উপস্থিত হয়ে ওইসব বাতিলের সাথে তর্কযুদ্ধ করেছেন এবং প্রতিটি মুনাযারা থেকে তিনি বিজয়ী বেশে ফিরে আসেন। এসব মুনাযারার ফলে সংশ্লিষ্ট এলাকা, এমনকি দেশের গোটা মুসলিম সমাজ একথা বুঝতে সক্ষম হয়েছেন যে, সুন্নী মতাদর্শই ইসলামের একমাত্র সঠিক মতাদর্শ। তাঁর ওইসব বিজয়ের ফলে সুন্নীরা হয়েছে বহুগুণ বেশী উৎসাহী, আর সৌভাগ্যক্রমে অনেক বাতিলও তাওবা করে ওহাবিয়াত ইত্যাদি ত্যাগ করে সুন্নী হয়ে গেছে। আর যাদের ভাগ্যে হিদায়ত নেই তারা হয়ে রয়েছে ধর্মীয় অঙ্গনে একেকটা ভ্রান্ত সম্প্রদায় হিসেবে চিহ্নিত। গত শতাব্দির ৪০ দশকের প্রারম্ভে চট্টগ্রাম শাহী জামে মসজিদে ক্বাদিয়ানীদের সাথেও এক যুগান্তকারী মুনাযারা (তর্কযুদ্ধ) অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। এতেও আল্লামা গাযী শেরে বাংলা অন্যতম প্রধান তর্কযোদ্ধা হিসেবে ছিলেন। এ মুনাযারাও সুন্নীরা আশাতীতভাবে বিজয়ী হয়েছিলেন। ওই তর্কযুদ্ধের ফলে বিশেষ করে চট্টগ্রাম থেকে ক্বাদিয়ানীরা প্রায় সম্পূর্ণ উৎখাতই হয়ে গেছে।

আজ সবাই জানে যে, জামায়াতে ইসলামী’র প্রতিষ্ঠাতা মি. মওদূদী একজন মহাভ্রান্ত লোক। তিনি যখন চট্টগ্রাম লালদীঘি ময়দানে জনসভা করার জন্য আসলেন তখন আল্লামা গাযী শেরে বাংলা অনেকটা একাকী গিয়ে তার ভ্রান্ত মতবাদগুলোকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। মওদূদী লা-জাওয়াব হয়ে সভা না করে চট্টগ্রাম ত্যাগ করেছিলেন। ফলে তার ভ্রান্তি ও পথভ্রষ্টতা জনসমক্ষে একেবারে ষ্পষ্ট হয়ে গিয়েছিলো।

তাছাড়া, সুদূর সৌদী আরবে, হজ্জের সফরে, ওহাবিয়াতের মূল সূীতিকাগারের নজদী-মুফতীদেরকেও আল্লামা গাযী শেরে বাংলা শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে সুন্নী মতাদর্শের সত্যতা প্রমাণ করেছিলেন। তদানীন্তন সৌদী সরকার তাকে ‘শায়খুল ইসলাম’ এবং দেশের শীর্ষস্থানীয় আলিমগণ সর্বসম্মতভাবে তাঁকে ‘শেরে বাংলা’ উপাধিতে ভূষিত করেন।

চতুর্থত: অসাধারণ ত্যাগ স্বীকারঃ আল্লামা গাযী শেরে বাংলা সুন্নীয়াতের প্রসার ও প্রতিষ্ঠার মোকাবেলায় কখনো পার্থিব কোন কিছুকে প্রাধান্য দেননি। একদা তিনি ঘরে মৃত শিশু-সন্তানকে একনজর দেখে দাফন করার জন্য অনুমতি দিয়ে মুনাযারায় চলে গিয়েছিলেন। যাবতীয় আয়ের বেশীর ভাগ ব্যয় করতেন তাঁর বিরুদ্ধে ওহাবীদের কৃত মামলা-মুকাদ্দমা চালাতে এবং ধর্মীয় কার্যাদিতে। তিনি ইনতিকালের সময় বিশেষ কোন সম্পদ কিংবা নগদ টাকা পয়সা রেখে যান নি।

দ্বীন ও মাযহাবের প্রচারণার তাগিদে তিনি নিজে জীবনের নিরাপত্তার বিষয়টিকে প্রাধান্য না দিয়ে সুন্নীয়াতের প্রচারনাকেই প্রাধান্য দিয়ে সেখানে ওয়ায করতে গিয়েছিলেন এবং সুন্নী মতাদর্শের বিষয়গুলোর পক্ষে যুক্তি প্রমাণ দিয়ে ওয়ায  করেছিলেন। কিন্তু ওহাবীরা তাঁকে শহীদ করার তাঁর উপর অতর্কিতভাবে হামলা চালিয়েছিলো।

হাসপাতাল ও তাঁকে ‘মৃত’ ঘোষণা করেছিলো। কিন্তু আল্লাহ্ ও রসূলের দরবারে এ মাক্ববূল  মুজাহিদের বহু কাজ তখনও বাকী ছিলো  বিধায় তাঁকে আল্লাহ্ ও রসূলের পক্ষ থেকে পুনরায় জীবন প্রদান করা হয়েছিলো।

আল্লামা গাযী শেরে বাংলা রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র নবীপ্রেমের এ দৃষ্টান্ত খুবই বিরল। বর্তমানেও আমাদের নবীপ্রেম ও ইশক্বে রসূলের বাস্তবতা প্রমাণের উপযুক্ত সময় এসেছে। সুন্নিয়াতের এহেন ক্রান্তিলগ্নে আল্লামা গাযী শেরে বাংলাকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করার বিকল্প নেই।

পঞ্চমতঃ আল্লামা গাযী শেরে বাংলা রাহমাতুল্লাহি আলায়হি সামাজিক, সাংগঠনিক এবং রাজনৈতিক অঙ্গনেও তাঁর বিভিন্ন  অবদান দ্বারা সুন্নী জামা‘আতকে গৌরবান্বিত করেছেন। আপন ইউনিয়নের তিনি ছিলেন দীর্ঘস্থায়ী অপ্রতিদ্বন্দ্বী চেয়ারম্যান। আক্বীদাগত শত্র“ ওহাবীরাও তাঁকে একজন বিশ্বস্ত সমাজপতি হিসেবে মানতো। তিনি ‘জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম’ নামক একটি ব্যাপক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে সাংগঠনিক যাত্রা আরম্ভ করেন। তিনি ‘আঞ্জুমানে ইশাআতে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত, (তদানীন্তন) পূর্ব পাকিস্তান’ নামক একটি সুন্নী সংগঠনও প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি  আজীবন আহলে সুন্নাতের ইমাম ছিলেন।

ষষ্ঠতঃ আদর্শ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে চাই যথোপযুক্ত ও যুগোপযোগী লেখনী। তাঁর লেখনীগুলোর মধ্যে ‘দিওয়ান-ই আযীয’, ‘মাজমূ‘আহ-ই ফাতা-ওয়া-ই আযীযিয়া’, ‘ঈযাহুদ দালালাত’ (ফাত্ওয়া-ই মুনাজাত) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এসব কিতাবে তিনি অকাট্য প্রমাণাদি সহকারে যুগ জিজ্ঞাসার জবাব ও শরীয়ত-তরীক্বতের যথাযথ দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন।

সপ্তমতঃ এ দেশে ইসলাম প্রচার করেছেন আউলিয়া-ই কেরাম। অগণিত পীর মাশাইখ আউলিয়া-ই কেরাম ইসলাম প্রচার ও ইসলামী শিক্ষা, সংস্কৃতি ও আদর্শের প্রচারণার ধারাবাহিকতাকে বহাল রেখেছেন। আল্লামা গাযী শেরে বাংলা রাহমাতুল্লাহি আলায়হি সুন্নী মুসলমান যাতে সত্যিকার আউলিয়া কেরাম ও পীর- মাশাইখের সান্নিধ্য পান ও তাঁদের যিয়ারত ও শিক্ষা ইত্যাদি দ্বারা উপকৃত হতে থাকেন, পক্ষান্তরে, ভন্ড প্রকৃতির লোকেরা যাতে ওলী-বুযুর্গদের নামে নিজেদের স্বার্থপরতাকে চরিতার্থ করতে গিয়ে সুন্নী জমা‘আতকে কলূষিত করতে না পারে তজ্জন্যও যথোপযুক্ত ভূমিকা পালন করে যান। নিজে গিয়ে সত্যিকারের বরকতময় জায়গা ও ব্যক্তিদের স্বীকৃতি দেন, তৎসঙ্গে ভণ্ডদের ভণ্ডামীর মুখোশও উম্মোচন করেছেন। তাঁর ‘দিওয়ানে আযীয’-এ তিনি দেশ বিদেশের বহু ওলীর প্রশংসা উঁচুমানের কাব্যাকারে লিখে এক্ষেত্রে পত্যক্ষ ও পরোক্ষ দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি বহু অজানা ওলীর সন্ধান দিয়েছেন। বহু ওলীর উঁচু মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্য নির্ণয় করেছেন।

এতদসঙ্গে তিনি কিছু ভ্রান্তআক্বীদা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীর মুখোশও উন্মোচন করেছেন তাঁর এ প্রামাণ্য কিতাবে। তিনি এ ক্ষেত্রে বহু স্পর্শকাতর বিষয়েরও যুগান্তকারী সমাধান দিয়েছেন। তিনি মুসলমানদেরকে সত্যিকার ওলী বুযুর্গদের সান্নিধ্যে থাকার উপদেশ দিতেন।

যুগখ্যাত ওলী-ই কামিল হযরত আবদুল হামিদ বাগদাদী রাহমাতুল্লাহি আলায়হির একনিষ্ঠ মুরীদ ও খলীফা ছিলেন তিনি। তাই, তরীকতের বায়‘আত করিয়ে মুসলমানদেকে রূহানীভাবে ফয়য দ্বারা ধন্য করারও অনন্য যোগ্যতা তাঁর মধ্যে ছিলো। কিন্তু তিনি তাঁর বেলায়তকে অনেকটা গোপন রেখে, বেশী লোককে বায়‘আত করান নি বরং মুসলিম সমাজকে হযরত সৈয়্যদ আহমদ শাহ সিরিকোটী পেশোয়ারী (শাহানশাহে সিরিকোট)’র হাতে বায়‘আত করার জন্য পরামর্শ  দিতেন। আর বলতেন, “শাহানশাহে সিরিকোট হলেন পীর-ই কামিল, আশেক্বে রসূল ও যমানার গাউস। তাঁর সিলসিলার মধ্যে সন্দেহযুক্ত কোন ব্যক্তি নেই। তাঁর দামান নাজাতের ওসীলা।”[আল্লামা গাযী শেরে বাংলা, জীবনী গ্রন্থ পৃষ্ঠা- ৯৬-৯৭]

অষ্টমতঃ সমসাময়িক প্রশ্নাবলীর অকাট্য সমাধান প্রদানঃ বেলায়তের একটি অতি উচ্চ পদ হচ্ছে ‘গাউসুল আ’যম’। তাবেঈ’র পর এ মহা মর্যাদা। এক বর্ণনামতে, এর আগে বেলায়তের আরো ১১টি বিশাল সোপান অতিক্রম করে একজন সত্যিকারের গাউসুল আ’যম হন। আ’লা হযরত ইমাম আহমদ রেযা বেরলভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র বর্ণনামতে, হযরত হাসান আসকারী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর পর বিশ্বব্যাপী ‘গাউসুল আ’যম’-এর পদটি হুযূর গাউসে পাক শায়খ আবদুল ক্বাদের জীলানী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে প্রদান করা হয়েছে। ইমাম মাহদী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু পর্যন্ত হুযূর শায়খ আবদুল ক্বাদের জীলানী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুই বিশ্বব্যাপী ‘গাউসুল আ’যম’।

এতদসত্ত্বে, অসাধারণ বেলায়তী শক্তি ও ‘গাউস’ সুলভ অসংখ্য কারামাত প্রকাশ পাবার কারণে অন্যান্য ওলী-বুযুর্গও মুসলিম সমাজে ‘গাউস’ বা ‘গাউসুল আ’যম’ হিসেবে আখ্যায়িত হয়ে থাকেন। আবার কেউ কেউ তার পীর-মুর্শিদের প্রতি অতি মাত্রায় ভক্তি দেখিয়ে এ উপাধি ব্যবহার করে থাকেন। অথচ নির্ভরযোগ্য বর্ণনাদিতে দেখা যায় যে, হুযূর গাউসে পাক যখন “ক্বাদামী হাযিহী আলা রাক্বাবাতি কুল্লি ওলিয়্যিল্লাহ” (আমার এ কদম আল্লাহর প্রত্যেক ওলীর গর্দানের উপর) ঘোষণা দিয়েছিলেন, তখন সমসাময়িক সমস্ত ওলী তাঁর এ ঘোষণাকে মাথা পেতে মেনে নিয়েছেন। পক্ষান্তরে, শায়খ সানা‘আনী তা মেনে না নেওয়ায় তাঁর বেলায়ত পর্যন্ত প্রত্যাহার করা হয়েছিলো। তদুপরি তিনি চরম পরীক্ষার সম্মুখীন হয়ে ঈমান পর্যন্ত হারাতে বসেছিলেন। তারপর গাউসে পাক দয়াপরবশ হয়ে তাঁকে উদ্ধার করেছিলেন। সুতরাং এমতাবস্থায় এ বিষয়ে একটি নির্ভরযোগ্য সমাধানের প্রয়োজনীয় দেখা দেয়।  আল্লামা গাযী শেরে বাংলা রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি এহেন অবস্থায় তাঁর ‘দিওয়ানে আযীয’-এ একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। তিনি হুযূর গাউসে পাক শায়খ আবদুল ক্বাদের জীলানী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহুকে ‘শাহে বেলায়ত’ বলেছেন। আর হুযূর গাউসে পাকের ওই ঘোষণাটিকে এভাবে বর্ণনা করেছেন- ‘পা-য়ে পা-কশ বর রেক্বা-বে হার ওলী-উল্লাহ বুয়াদ।’ অর্থাৎ তাঁর কদম প্রত্যেক ওলীর গর্দানের উপরই।  [দিওয়ানে আযীয, পৃষ্ঠা- ৩৯-৪০]

সুন্নী মুসলমানগণ আল্লামা গাযী শেরে বাংলা রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র এ ফয়সালা ও সুবিন্যস্থ বিবরণকে নিদ্বির্ধায় মেনে নেওয়াকে এ ক্ষেত্রে নিরাপদ বলে মনে করেন।

শরীয়তের মাসআলা মাসাইলের সমাধান

ওহাবীরা আল্লাহ তা‘আলা ও নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর মানহানি করে থাকে। তারা আল্লাহর জন্য মিথ্যা বলা সম্ভব (ইমকানে কিযব) ইত্যাদি এবং নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লামকে বড় ভাইয়ের মতো বলে, আরো বলে- নবী পাক গায়ব জানেন না। নবীর খেয়াল নামাযে আসলে…ইত্যাদি। এগুলোই হচ্ছে ওহাবীদের সাথে সুন্নী মুসলমানদের বিরোধের মৌলিক কারণ। এ আক্বীদাগুলোর সাথে সংশ্লিষ্ট শরীয়তের কিছু মাসআলাও রয়েছে। ওইগুলো শরীয়ত মতে বৈধ ও বরকতময় হওয়া সত্ত্বেও ওহাবীরা মনগড়াভাবে সেগুলোকে হারাম, শির্ক নাজায়েয ফাত্ওয়া দিয়ে বসে। আল্লামা গাযী শেরে বাংলা আক্বাইদ সংক্রান্ত হোক আর শরীয়ত সংক্রান্ত হোক যে কোন মাস‘আলা বা বিষয়ে যখন ও যেখানে ভুল ফাত্ওয়া দেওয়া হয়েছে তখনই সেখানে গিয়ে সেটার প্রতিবাদ ও প্রতিকার করেছেন।

সাজদাহ্ তাহিয়্যাহ্ (তা’যামী সাজদাহ্) সম্পর্কে  মীমাংসা

পূর্ববর্তী শরীয়তে সম্মানের জন্য সাজদা জায়েয থাকলেও আমাদের শরীয়তে সেটার বিকল্প ব্যবস্থা দেওয়া হয়েছে- সালাম। যেমনিভাবে ‘বিসমিল্লাহ’দেওয়া হয়েছে জাহেলী যুগের বোতের নামে কোন কাজ শুরু করার বিকল্প পদ্ধতি হিসেবে। তবুও কোন কোন বুযুর্গ আলিম সেটাকে আমাদের শরীয়তেও জায়েয বলেছেন। সুতরাং এ প্রসঙ্গেও একটি মীমাংসাসুলভ অভিমতের প্রয়োজন দেখা দেয়। আল্লামা গাযী শেরে বাংলা তাঁর ‘দিওয়ানে আযীয’-এ উভয় পক্ষের দলীলগুলোকে একত্রিত করে এ প্রসঙ্গে সুন্দর ফয়সালা দিয়েছেন। উভয় পক্ষের (অর্থাৎ হালাল কিংবা হারাম হবার পক্ষে) যুক্তি প্রমাণ থাকলেও ….

এ যুগ যেহেতু ফিৎনায় ভর্তি হয়ে গেছে, সেহেতু সাজদা-ই তাহিয়্যাহ্ বা তা’যীমী সাজদাকে হালাল বলে ফাতওয়া দেওয়া ভুল হবে। [দিওয়ানে আযীয, পৃষ্ঠা- ১৭০]

ধর্মীয় কাজে মাইক ব্যবহার প্রসঙ্গে

মাইক আবিস্কৃত হবার পর থেকে মাইকযোগে রাজনৈতিক থেকে আরম্ভ করে, যে কোন কথা বা বাক্য ইত্যাদি একসাথে বহুসংখ্যক শ্রোতার নিকট পৌঁছানো হচ্ছে। এমতাবস্থায় ধর্মীয় কথাবার্তা, ওয়ায-নসীহত, ক্বোরআন মজিদের তেলাওয়াত ইত্যাদির বেলায় মাইক ব্যবহারকে না জায়েয বলার কোন কারণ থাকতে পারে না। অবশ্য, নামাযের ক্ষেত্রে মুকাব্বির নিয়োজিত রেখে প্রয়োজনে মাইক ব্যবহার করার বিপক্ষে যতই কথা বলা হোক না কেন, তাকে ‘তাক্বওয়ার’ পরিপন্থী বলার চেয়ে বেশি কিছু বলা যায় না। প্রয়োজনের শর্ত সাপেক্ষে ‘ফাত্ওয়া’ কিন্তু বৈধতার পক্ষে। কিন্তু এতদ্সত্ত্বেও কিছু লোক নির্বিচারে মাইক ব্যবহারকে ‘নাজায়েয’ ‘হারাম’, ‘অগ্নিপূজা’, ‘নূরকে আগুন জ্বালিয়ে ফেলছে’ ইত্যাদি বলে শোর-চিৎকার শুরু করে দিলে আল্লামা গাযী শেরে বাংলা রাহমাতুল্লাহি আলায়হি তাঁর ‘দিওয়ান-ই আযীয’-এ সেটার সমাধানও দিয়েছেন। তিনি ওয়ায ইত্যাদির মজলিসে মাইক ব্যবহারের বৈধতার পক্ষে ‘ইজমা’ হয়েছে বলে প্রমাণ করে এর বিরোধিতা করাকে হঠকারিতা, ফাসেক্বী, পথভ্রষ্টতা ও মূর্খতা বলে আখ্যায়িত করেছেন। তাছাড়া, আল্লামা গাযী শেরে বাংলা আলাইহির রাহমাহ্ বরকতময় রাতগুলোতে নফল নামায জমা‘আতসহকারে পড়ার পক্ষে সপ্রমাণ আলোচনা করেছেন তাঁর ‘দিওয়ান-ই আযীয’-এর ৪৩১ পৃষ্ঠায়। (বাংলা সংস্কারণ দ্রষ্টব্য)

নবমত: তিনি তাঁর সাথে রেখে হাতে কলমে শিক্ষা এবং উৎসাহ দিয়েও বহু যোগ্য আলিম, মুনাযের, সচেতন ও নিষ্ঠাবান উত্তরসূরী তৈরি করে গেছেন, যা বর্তমানে বিশেষ করে আমাদের সুন্নী অঙ্গনে খুব কমই দেখা যায়! অথচ এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণও। এমনটি না থাকার কাজ অনেক সুন্নী আলিমের সন্তানগণ পর্যন্ত পথভ্রষ্ট হয়ে গেছে ও যাচ্ছে।

দশমত: এ উপমহাদেশে ‘ওহাবিয়াৎ (ওহাবী মতবাদ)-এর আমদানীকারক ও প্রতিষ্ঠাতা হলেন সৈয়্যদ আহমদ বেরেলভী। নবী, ওলীর মানহানি, পীর-মুরীদি ও ওসীলা গ্রহণ ইত্যাদিকে শির্ক মনে করে ওহাবী মতবাদে। অথচ সৈয়্যদ আহমদ বেরলভী নিজে পীর সেজে উপমহাদেশের অনেক লোককে পীর-মুরীদীর জন্য খিলাফতও দিয়েছেন তিনি। তার সহযোগী ছিলেন মৌং ইসমাঈল দেহলভী। তাদের স্বরূপ উন্মোচন করে গেছেন আমাদের ইমাম আল্লামা গাযী শেরে বাংলা আযীযুল হক আলকাদেরী লিখেছেন-

অর্থাৎ এখন সৈয়্যদ আহমদ বেরলভীর কথা বলছি, শেনো! লোকটি নবীকুল সরদার সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে বেয়াদবী করেছে।

অর্থাৎ তার সিরাতে মুস্তাক্বীম কিতাবে, হে যুবক! একটি বার দেখো! হে যুবক! ‘শায়খের প্রতি ধ্যান করা’ সম্পর্কে বলতে গিয়ে সে এমনটি করেছে।

অর্থাৎ ওই কিতাবে ইসমাঈল দেহলভীর নাম (সম্পর্ক) লেখক হিসেবে; কিন্তু সেটার সম্পূর্ণ বচন সৈয়্যদ আহমদ বেরেলভীরই।

অর্থাৎ  ‘যখীরাহ্-ই কারামত’-এ এমনি লিপিবদ্ধ রয়েছে। একজন সত্যানুসন্ধানীর জন্য এতটুকু যথেষ্ট।

অর্থাৎ যে সিলসিলায় সৈয়্যদ আহমদ বেরলভী এসেছে, সেটা হুযূর মুহাম্মদ মোস্তফার দয়া ও বরকত থেকে কর্তিত।

পরিশেষে, আল্লামা গাযী শেরে বাংলা রাহমাতুল্লিাহি  আলায়হি ছিলেন- আহলে সুন্নাতের মহান ইমাম। ইসলামের প্রকৃত আদর্শের প্রতিষ্ঠা ও সংরক্ষণের জন্য তিনি সাধ্যমতো প্রয়োজনীয় সব কিছু করেছেন। এগুলো করতে গিয়ে তিনি অনন্য ত্যাগের মহিমা প্রদর্শন করেছেন। তিনি একথাও প্রতিষ্ঠা করেছেন যে, আল্লাহ ও তাঁর রসূলের ভালবাসাই মানুষের নাজাত ও মর্যাদালাভের একমাত্র উপায়। আর এ ভালবাসার বাস্তব প্রমাণ হচ্ছে প্রেমাষ্পদের মর্যাদাকে যে কোন কিছুর বিনিময়ে তুলে ধরা, পক্ষান্তরে প্রেমাষ্পদের মান-মর্যাদার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হলে তাও প্রতিহত করার জন্য সোচ্চার হওয়া এবং যুগোপযোগী ও তৎক্ষণিকভাবে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা। আর এ জন্য চাই ত্যাগ ও নিষ্ঠা, প্রয়োজনে নিজের প্রাণটুকু পর্যন্ত বিসর্জন দেওয়া।

বলা বাহুল্য, বর্তমানে সুন্নীয়াতের মোকাবেলায় বিপরীত চিন্তাধারার লোকেরা তাদের অবস্থান গড়ে নিয়ে শুধু সুন্নীয়াতের বিরুদ্ধে হামলা করছে না বরং তাদের উচ্চাভিলাষকে চরিতার্থ করার জন্য যথেচ্ছ কাজ করে জাতীয় জীবনকেও দূর্বিসহ করে তুলছে, সর্বোপরি, বদনাম করছে আমাদের পূতপবিত্র ধর্মেরও। এমতাবস্থায় আমাদের জ্ঞানী, গুণী, অর্থশালী বুদ্ধিজীবী ও সচেতন, অসচেতন সবাই আল্লামা গাযী শেরে বাংলা রাহমাতুল্লাহির আদর্শের অনুসরণ করলে সকলের জন্য সুফল বয়ে আনবে। উল্লেখ্য, আল্লামা গাযী শেরে বাংলার আদর্শ জীবনের দিকে তাকালে ইমাম হোসাইন, ইমাম আবু হানীফা, মুজাদ্দিদে আলফেসানী, হযরত শাহ জালাল ইয়েমেনী, আল্লামা ফযলে হক খায়রাবাদী, আ’লা হযরত ফাযেলে বেরলভী প্রমুখ বুযুর্গের আদর্শের চিত্র চোখের সামনে উদ্ভাসিত হয়। আরো অনুমান করা যায়- ইলমে লাদুন্নীর ধারক হুযূর চৌহরভী, শাহানশাহে সিরিকোট হযরত সাইয়্যেদ আহমদ শাহ সিরিকোটী ও হুযূর ক্বেবলা আল্লামা তাইয়্যেব শাহ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি ও হুযূর কেবলা আল্লামা সাইয়্যেদ মুহাম্মদ তাহের শাহ সাহেব মুদ্দাজিল্লুহুল আলীর বেলায়তী শক্তি, সাহস, দূরদর্শিতা ও আন্তরিকতার বাস্তব দৃশ্য। মোটকথা, একজন আশেক্বে রসূল ও ইমামের বহুমুখী যোগ্যতার যথাযথ নমুনা তিনি পরবর্তীদের জন্য রেখে গেছেন। আর তিনিও হয়েছেন আল্লাহ এবং তাঁর হাবীবের একান্ত প্রিয়ভাজন। সাথে সাথে আমাদের ভেবে দেখার প্রয়োজন যে, আল্লামা গাযী শেরে বাংলার পরবর্তীতে তাঁর মতো আপোষহীন, সচেতন, নিষ্ঠাবান, ত্যাগী ও অকৃত্রিম রসূল প্রেমিক কাণ্ডারী ও উত্তরসূরী তৈরী হয়েছে কিনা। আমাদের ভাবতে হবে- সুন্নী অঙ্গনে এখন যে অবস্থা বিরাজ করছে তা ভবিষ্যতের জন্য কতটুকু ফলপ্রসূ হবে?

আসুন, আমরা আমাদের আদর্শ ইমাম ও পূর্বসুরীদের আদর্শানুকরণে ব্রতী হই! আল্লাহ পাক সফল করুন। আমীন!

[সূত্র. মাসিক তরজুমান-রজব ১৪3২ হিজরি]

আপনার পছন্দের আর দেখুন
WhatsApp Channel Join Now
Telegram Group Join Now

Post a Comment

Assalamu Alaikum Wa Rahmatullah
Greetings!
Provide your feedback.